আল্লাহর কথা ও বিধান পরিবর্তন হয় কি?



🖋Author: Ashraful Nafiz
____________________________________________

অনেককে দেখা যায় বিভিন্ন বিষয় দেখিয়ে বলে আল্লাহ এটা কেন রহিত করলেন, সেটা কেন রহিত করলেন, এটা কেন পরিবর্তন করলেন, সেটা কেন পরিবর্তন করলেন অথচ আল্লাহ নিজেল বলেছেন উনার কথায় রদবদল হয় না, বাণীসমূহ পরিবর্তন হয় না, বিধানের পরিবর্তন হয় না! যেমন কোরআনে রয়েছে, 


‘আমার কাছে কথা রদবদল হয় না, আর আমি বান্দার প্রতি যুলমকারীও নই’। [সূরা কাফ আয়াত ২৯]

তাদের জন্যই সুসংবাদ দুনিয়াবী জীবনে এবং আখিরাতে। আল্লাহর বাণীসমূহের কোনো পরিবর্তন নেই। এটিই মহাসফলতা। [সূরা ইউসুফ আয়াত ৬৪]

সূরা ফাতাহ আয়াত ২৩; সূরা ফাতির আয়াত ৪৩; সূরা বনী ইসরাইল আয়াত ৭৭; সূরা আহযাব আয়াত ৬২ এই আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে আল্লাহর বিধান পরিবর্তন হয় না।

এখন স্বাভাবিকভাবেই মনে খটকা লাগবে যে যদি বিধান পরিবর্তন না হয়, কথা বা বাণীর রদবদল বা পরিবর্তন না হয় তাহলে যে বিধান পরিবর্তন করা হয়েছে, রহিত করা হয়েছে সেগুলো কি এই আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক না!? এই বিষয়েই আজকে ইনশাআল্লাহ বিস্তারিত আলোচনা করব।

আল্লাহর কথার পরিবর্তন হয় না মানে কি?

প্রথমেই পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কিছু কথা দেখে নিই, আল্লাহ বলেছেন,

আল্লাহ যা ইচ্ছে তা করেন [সূরা বুরুজ আয়াত ১৬; সূরা আল বাকারা ২৫৩; সূরা হজ আয়াত ১৪, ১৮]

 নিশ্চয় আল্লাহ যা ইচ্ছা বিধান দেন। [সূরা মায়েদা আয়াত ১]

আমি যে আয়াত রহিত করি কিংবা ভুলিয়ে দেই, তার চেয়ে উত্তম কিংবা তার মত আনয়ন করি। তুমি কি জান না যে, আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। [সূরা বাকারাহ আয়াত ১০৬]

আর যখন আমি একটি আয়াতের স্থানে পরিবর্তন করে আরেকটি আয়াত দেই- আল্লাহ ভাল জানেন সে সম্পর্কে, যা তিনি নাযিল করেন- তখন তারা বলে, তুমি তো কেবল মিথ্যা রটনাকারী; রবং তাদের অধিকাংশই জানে না। [সূরা নাহল আয়াত ১০১]

আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন মিটিয়ে দেন এবং যা ইচ্ছা করেন স্থির রাখেন, আর তাঁর কাছেই রয়েছে মূল কিতাব। [সূরা রাদ আয়াত ৩৯]

‘আর আমার (ঈসা আ.) সামনে পূর্ববর্তী কিতাব তাওরাতের যা রয়েছে তার সত্যায়নকারীরূপে এবং তোমাদের উপর যা হারাম করা হয়েছিল তার কিছু তোমাদের জন্য হালাল করতে এবং আমি তোমাদের নিকট এসেছি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে নিদর্শন নিয়ে। অতএব, তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং আমার আনুগত্য কর’। [সূরা আলে ইমরান আয়াত ৫০]

উপরিউক্ত আয়াতে আল্লাহ বলেছেন আল্লাহর কথায় কোন পরিবর্তন নেই, আবার আল্লাহ এটাও বলেছেন তিনি যা ইচ্ছা তাই করেন, যা ইচ্ছা তা বিধান দেন। এখান আল্লাহ যদি কোন বিধান আগে দিয়ে থাকেন ও পরে সেটা পরিবর্তন করেন, তাহলেতো তা আল্লাহর বলা ‘যা ইচ্ছা করেন’, ‘যা ইচ্ছা বিধান দেন’ এই কথা অনুসারেই পরিবর্তন করেছেন। এই ক্ষেত্রে আল্লাহর বাণীতেও কোন পরিবর্তন হচ্ছে না আবার বিধানও পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।


বিষয়টা আরেকটু ক্লিয়ার করে বলি, আল্লাহ বলেছেন আল্লাহর কথায় রদবদল হয় না, আবার তিনিই বলেছেন তিনি যা চান বা উনার যা ইচ্ছা তিনি তাই করেন, বিধান দেন। এখন তিনি কোন বিধান পরিবর্তন করলে আপাত দৃষ্টিতে সেটা রদবদল বা পরিবর্তন মনে হতে পারে, কিন্তু আল্লাহতো বলেছিলেনই যে তিনি যা ইচ্ছা তাই করেন, বিধান দেন। সেহেতু যদি বলেন আল্লাহ বিধান পরিবর্তন করলেন কেন তাহলে এর উত্তর হল আল্লাহ যা চান তাই করেন বলেছেন তিনি। যদি বলেন এটাতো কথার পরিবর্তন তাহলে এটা আপনার ভুল, কারণ আল্লাহ বলেছেন ‘আল্লাহর কথা পরিবর্তন হয় না’ সেহেতু তিনি ‘যা ইচ্ছা তা করেন’, ‘যা ইচ্ছা বিধান দেন’ বলা ধরুন বিধান পরিবর্তন করেছেন, এভাবে আল্লাহর কথাও পরিবর্তন হয় না, আল্লাহ বলেছেন প্রয়োজনে আয়াত রহিত করেন এবং তিনি সেটাও করেছেন, পূর্বের নবিদের সময় থাকা বিধিনিষেধ প্রয়োজনে পরবর্তী বা অন্য নবীর কাওমের ক্ষেত্রে কম বেশি করবেন সেটার করেছেন। এভাবেই আল্লাহ সব কিছুই করেছেন কিন্তু তারপরও আল্লাহ কথা রদবদল হয়নি, তিনি যা যা বলেছেন সব কিছুই সেভাবে করেছেন। তাই যেহেতু আল্লাহ বলেই দিয়েছেন যে তিনি যা ইচ্ছা তাই করেন, যা ইচ্ছা তাই বিধান দেন, তিনি প্রয়োজনে আয়াত রহিত করেন, পূর্বের বিধান পরিবর্তন করেন সেহেতু আল্লাহ যদি এইগুলো করেন তাহলে আপনি এটাকে রদবদল বলতে পারবেন না, কারণ আল্লাহ যে এগুলো করবেন তিনি আগেই সেটা বলে দিয়েছিলেন, সে হিসেবে আল্লাহ নিজের কথা অনুসারেই কাজ করেছেন যার কারণে উনার কথায় রদবদল হয়নি।


এছাড়া আল্লাহ পূর্বের নবিদের বিধান পরিবর্তন করবেন না বা বাতিল করে নতুন বিধান দিবেন না, বা সব নবিদের কাওমের জন্য সব বিধিবিধান একরকম এই জাতীয় কথা কিন্তু বলেননি কোরআনে। আবার তিনি প্রয়োজনে কৌশল, বিদান, নিয়ম-নীতি বিধি-নিষেধ ইত্যাদি পরিবর্তন বা কম বেশি করবেন না বা করার হুকুম দিবেন না এমনটাও বোঝাননি। যেমনটা আমরা কোরআনেই অন্য আয়াতগুলোতে দেখতে পেয়েছি।


আল্লাহর কথার রদবদল হয় না এই দাবিটার জবাব আরো এক ভাবে দেওয়া যায়। যেমন আপনি যদি সূরা ইউসুফ আয়াত ৬৪ ও সূরা কাফ আয়াত ২৯ এর আগে পিছের আয়াত সহ পড়ে দেখেন তাহলে স্পষ্টই বুঝতে পারবেন যে এই আয়াতে আখিরাত সম্পর্কে, দুনিয়া সম্পর্কে আল্লাহ যে ওয়াদা দিয়েছেন, কথা দিয়েছেন বা যে-সব জানিয়েছেন সেগুলো পরিবর্তন হয় না বা হবে না এমনটা বলা হয়েছে। তাফসির গ্রন্থগুলোতেও দেখলে দেখা যায় যে সেখানে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ্ তা'আলা মুমিন মুত্তাকিদের সাথে যে ওয়াদা করেছেন তা কখনো পরিবর্তনশীল নয়, এটা স্থায়ী অঙ্গীকার। কোনটা করলে দুনিয়া ও আখিরাতে কি শাস্তি দিবেন, কোনটা করলে দুনিয়া ও আখিরাতে কি প্রতিদান দিবেন, কখন আল্লাহ কি দিবেন, না দিবেন এইসব বিষয়ে আল্লাহ যে অঙ্গীকার করেছেন, যা বলেছেন সেগুলোর বিপরীত কিছুই হবে না।’ [তাফসিরে কুরতুবি ৮/৩৫৯, ১৬/১৭; তাফসিরে আহসানুল বায়ান ৯১১ পৃষ্ঠা, ইসলামিক সেন্টার; তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন ১২৯১, বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসির, অনুবাদক মুহিউদ্দীন খান; তাফসির ইবনে কাসির ৪/২৪২-২৪৫, ৭/৩৭৬-৭৭; তাফসিরে তাকী উসমানি ১৫৯৬ পৃষ্ঠা]

আল্লাহর বিধান পরিবর্তন হয় না!

আল্লাহ বলেছেন উনার বিধান পরিবর্তন হয় না তাহলে তারপরও কেন আমরা পরিবর্তন দেখতে পাই, এই জাতীয় প্রশ্নটা আসে মূলত আমরা কনটেক্সট না জানা কারণে, কোন আয়াতে কি কারণে কি বলা হয়েছে তা আমাদের জানা না থাকার কারণেই মূলত আমাদের এই ভুল ধারণাগুলো জন্মে। তাহলে আমরা এক এক করে দেখে আসি সেই আয়াতগুলোতে আসলে আল্লাহ কি বলেছেন।

আর যারা কুফরী করেছে তারা যদি তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে তবে অবশ্যই তারা পিঠ দেখিয়ে পালাবে। তারপর তারা কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না। তোমাদের পূর্বে যারা গত হয়েছে তাদের ব্যাপারে এটি আল্লাহর নিয়ম; আর তুমি আল্লাহর নিয়মে কোন পরিবর্তন পাবে না। [সূরা ফাতাহ আয়াত ২২-২৩]

এই আয়াত দ্বারা আল্লাহ বুঝাতে চেয়েছেন যখন কুফরী ও ঈমানের মধ্যে চূড়ান্ত ফয়সালাকারী যুদ্ধ-পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যারা সত্যের উপর থাকে এবং আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে সাহায্যপ্রাপ্তির শর্তাবলি পূরণ করে, মহান আল্লাহ তাআলা ঈমানদারদের সাহায্য করে বাতিল পন্থিদের উপর বিজয় দান করেন ও সত্যকেই শীর্ষস্থান দান করেন। যেমন, আল্লাহর এই রীতি অনুসারে বদর যুদ্ধে তোমাদেরকে সাহায্য করা হয়েছে। কোথাও যদি বাতিল পন্থিদেরকে বিজয়ী হতে দেখা যায়, তবে বুঝতে হবে, সত্য পন্থিদের বিশেষ কোন ত্রুটি ছিল, যার পরিণামে তারা আল্লাহ তাআলার সাহায্য থেকে বঞ্চিত থেকেছে। আর আল্লাহর এ নিয়ম-নীতিই পূর্ব থেকে চলে আসছে। [তাফসিরে আহসানুল বায়ান, তাফসিরে তাকি উসমানি, তাফসির ইবনে কাসির, তাফসিরে কুরতুবি, সূরা ফাতাহ আয়াত ২৩ এর তাফসির]

আর তারা দৃঢ়তার সাথে আল্লাহর নামে কসম করে বলত যে, যদি তাদের কাছে কোন সতর্ককারী আসে, তাহলে তারা অবশ্যই অন্য যে কোন জাতির চেয়ে অধিক হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে; কিন্তু যখন তাদের নিকট সতর্ককারী আসল, তখন তা কেবল তাদের বিমুখতাই বৃদ্ধি করল, যমীনে উদ্ধত আচরণ ও কূটচক্রান্তের কারণে। কিন্তু কূটচক্রান্ত কেবল তার ধারককেই পরিবেষ্টন করবে। তবে কি তারা পূর্ববর্তীদের (উপর আল্লাহর) বিধানের অপেক্ষা করছে? কিন্তু তুমি আল্লাহর বিধানের কখনই কোন পরিবর্তন পাবে না এবং তুমি আল্লাহর বিধানের কখনই কোন ব্যতিক্রমও দেখতে পাবে না। আর তারা কি যমীনে ভ্রমণ করে না? তাহলে তারা দেখত, কেমন ছিল তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম। অথচ তারা তো শক্তিতে ছিল এদের চেয়েও প্রবল। আল্লাহ তো এমন নন যে, আসমানসমূহ ও যমীনের কোন কিছু তাকে অক্ষম করে দেবে। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। আর যদি আল্লাহ মানুষদেরকে তারা যা অর্জন করেছে তার জন্য পাকড়াও করতেন, তাহলে যমীনের উপর একটি প্রাণীকেও তিনি ছেড়ে দিতেন না। কিন্তু তিনি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদেরকে বিলম্বিত করে থাকেন। অতঃপর যখন তাদের সেই নির্দিষ্ট সময় এসে যায় (তখন তিনি তাদের পাকড়াও করেন), কেননা আল্লাহ তো তাঁর বান্দাদের ব্যাপারে সম্যক দ্রষ্টা। [সূরা ফাতির আয়াত ৪২-৪৫]

দেখা যাচ্ছে এই আয়াতে আল্লাহ কাফের-মুশরিকদেরকে সতর্ক করছেন। আল্লাহর আযাব দূরকারী অথবা তার গতিমুখ পরিবর্তনকারী কেউ নেই। অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা যে জাতিকে শাস্তি দিতে চান, তার গতিমুখ অন্য জাতির দিকে কেউ ফিরিয়ে দেবে, এমন শক্তি কারোর নেই। আল্লাহর এই রীতি ও বিধান বর্ণনার উদ্দেশ্য হল, আরবের মুশরিকদেরকে ভীতি প্রদর্শন করা যে, এখনো সময় আছে, তারা কুফরী ও শিরক ছেড়ে দিয়ে ঈমান নিয়ে আসুক। নচেৎ আল্লাহর সেই পূর্ববর্তীদের উপর দেওয়া শাস্তি রীতি থেকে তারাও নিষ্কৃতি পাবে না। অবিলম্বে বা বিলম্বে তার শাস্তি ভোগ করতেই হবে। আল্লাহর সেই রীতিকে কেউ না পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে, আর না কেউ আল্লাহর শাস্তিকে প্রতিহত করতে পারবে। আল্লাহ নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত সুযোগ দেন, সেই নির্দিষ্ট সময়টা চলে আসলে তাদেরকে তাদের পূর্ববর্তীদের উপর আসা শাস্তি ও আজাবের বিধানের মত বিধান বা নিয়ম থেকে কেউ রেহাই করতে পারে না, কেউ বাঁচাতে পারবে না। [তাফসিরে মারেফুল কোরআন, তাফসিরে আহসানুল বায়ান, তাজকিরুল কোরআন, তাফসিরে তাকি উসমানি, তাফসির ইবনে কাসির, ফাতহুল কাদির আল শাওকানি, সূরা ফাতির আয়াত ৪৩]

আর তাদের অবস্থা এমন ছিল যে, তারা তোমাকে যমীন থেকে উৎখাত করে দেবে, যাতে তোমাকে সেখান থেকে বের করে দিতে পারে এবং তখন তারা তোমার পরে স্বল্প সময়ই টিকে থাকতে পারত।তোমার পূর্বে আমি আমার যে সব রসূল পাঠিয়েছিলাম তাদের ক্ষেত্রে এটাই ছিল নিয়ম আর তুমি আমার নিয়মের কোন পরিবর্তন দেখতে পাবে না। [সূরা বনী ইসরাইল আয়াত ৭৭]

অর্থাৎ সকল নবীর ব্যাপারে, আল্লাহ এ একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। অর্থাৎ যে জাতি তাদেরকে হত্যা ও দেশান্তরী করেছে, তারপর সে জাতি আর বেশিদিন স্বস্থানে অবস্থান করতে পারেনি। আল্লাহর আযাব তাদের উপন নাজিল হয়। কাফেরদের জন্য আজাব অনেকভাবেই হতে পারে যেমন নবীকে সেই জায়গার উপরই ক্ষমতাবান করা, বা সেই এলাকাবাসীর উপর সরাসরি আল্লাহ আজাব আসা, বা সেই এলাকা বাসিকে কোন মাধ্যমে নিজ স্থান থেকে বের করে দেওয়া ইত্যাদি। [তাফসিরে জাকারিয়া, তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন, তাফসির ইবনে কাসির, তাফসিরে তাবারি, তাফসীর ইবনুল জাওযী, তাফসিরে নাফাসি, সূরা ইসরা আয়াত ৭৭]

হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিনদের নারীদেরকে বল, ‘তারা যেন তাদের জিলবাবের কিছু অংশ নিজেদের উপর ঝুলিয়ে দেয়, তাদেরকে চেনার ব্যাপারে এটাই সবচেয়ে কাছাকাছি পন্থা হবে। ফলে তাদেরকে কষ্ট দেয়া হবে না। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। যদি মুনাফিকগণ এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তারা ও শহরে মিথ্যা সংবাদ প্রচারকারীরা বিরত না হয়, তবে আমি অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে তোমাকে ক্ষমতাবান করে দেব। অতঃপর তারা সেখানে তোমার প্রতিবেশী হয়ে অল্প সময়ই থাকবে, অভিশপ্ত অবস্থায়। তাদেরকে যেখানেই পাওয়া যাবে, পাকড়াও করা হবে এবং নির্মমভাবে হত্যা করা হবে। ইতঃপূর্বে যারা অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এটাই ছিল আল্লাহর রীতি, আর তুমি আল্লাহর রীতিতে কখনই কোন পরিবর্তন পাবে না। [সূরা আহযাব আয়াত ৫৯-৬২]

এই আয়াতে মুনাফিকদের বিষয়ে বলা হয়েছে, যারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড করে ও মুসলিমদের নামে মিথ্যা রটায়, অপবাদ দেয়, সংঘাত সৃষ্টি করে। এই ধরনের ব্যক্তিদেরকে সতর্ক করা হয়েছে, যদি তারপরও ভালো না হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে বর্ণিত পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে বলেছেন আল্লাহ। আর মুনাফিকদের বিষয়ে এটা পূর্বেও বিধান করা হয়েছিল। [তাফসিরে মাআরিফুল কুরআন, তাফসিরে তাবারি, তাফসির ইবনে কাসির, তাফসির ইবনে জুযী, ফাতহুল কাদির আল শাওকানি, সূরা আহযাব আয়াত ৬২ এর তাফসির]


এই থেকে বুঝতে পারলাম আসলে এখানে বিধান বলতে নির্দিষ্ট কিছু বিধানের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম, বিধান সব সময় এক রকম থাকে বা যা আগের নবীদের সময় যেমন ছিল সেভাবেই চলতে থাকে, সেগুলোতে আল্লাহ পরিবর্তন আনেন না। 


রহিতকরণ

আশা করি আল্লাহ কথা, বাণী, বিধান পরিবর্তন হয় না এই বিষয়ে যত ধরনের অভিযোগ, বিভ্রান্তি ও সন্দেহ ছিল সব কিছুর সমাধান হয়ে গেছে। অর্থাৎ আল্লাহ প্রয়োজনে বিধান, নিয়ম নীতি, রীতি নীতি, প্রক্রিয়া, কৌশল ইত্যাদি পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন, রহিত, কমানো, বাড়ানো ইত্যাদি করতে পারেন। যেমন কিছু উদাহরণ দিই,


স্ত্রীর ইদ্দতের সময়কাল ১ বছর থেকে পরিবর্তন করে ৪ মাস ১০ দিন করা হয়। [বাক্বারাহ ২৩৪-৪০], নারী ব্যভিচারিণীর শাস্তি প্রথমে স্থগিত রাখা হয় পরে চূড়ান্ত ফয়সালা দেওয়া হয় [সূরা নিসা আয়াত ১৫, সূরা নূর আয়াত ২], এছাড়া কিবলা পরিবর্তন [সূরা বাকারা ১৪২-১৪৯], মুতাহ বিবাহ হারাম করা [সূরা নিসা আয়াত ২৪; বুখারি ৫১১৭-৫১১৯; সহিহ মুসলিম ১৪০৭; সুনানে নাসায়ী ৩৩৬৯], কোরবানির মাংস ৩ দিনের বেশি রাখা অনুমতি [মুসলিম ৯৭৭; আবু দাঊদ ৩৬৯৮; নাসাঈ ৫৬৫২], ৫০ ওয়াক্ত সালাত ৫ ওয়াক্ত হওয়া [সহিহ, বুখারি ৩২০৭, মুসলিম (ইসলামিক সেন্টার) ৩২৩, ৩২৪; সুনানে নাসায়ী ৪৪৮-৪৪৯] এছাড়া পূর্ববর্তী নবীদের সময় থেকে চলে আসা বিভিন্ন বিধান যেমন হজ, রোজা, সালাক, কোরবানি বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি ইত্যাদির পদ্ধতি ও নীয়ম-কানুনেও পরিবর্তন করা হয়েছে। আপনারা খুঁজলে আরো অনেক পেয়ে যাবেন রহিত আয়াত ও রহিত ও পরিবর্তিত অন্য বিধান সমূহ।


এত কিছু যেহেতু বললাম সেহেতু আরো একটা বিষয়ে কথা বলে নি। অনেকে উপরে এতক্ষণ যেগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি অর্থাৎ আল্লাহ কথা, বিধান পরিবর্তন হয় না এইগুলো দেখিয়ে দাবি করে কোরআনে কন্ট্রাডিকশন রয়েছে, কোরআনের অনেক আয়াতকে পরে অন্যদের দ্বারা মুছে ফেলা হয়েছে, পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে, বিধান বাতিল করে দেওয়া হয়েছে তাই কোরআন আল্লাহর বাণী নয়।


তো এই দাবিগুলোর খণ্ডনতো আশা করি হয়েছে গেছে। এখন রহিত করার সিস্টেম নিয়ে আলোচনা করি ছোট করে। ওলামাগণ বলেছেন রহিত করার ৩টি প্রকার পাওয়া যায়, [শারহ মুসলিম ১০/২৯; ইবনে সালামা, আল-নাসিখ ওয়া আল-মানসুখ, কায়রো, ১৯৬৬, পৃ.৫; আব্দুল্লাহ সাইদ - কোরানের ব্যাখ্যা করা: একটি সমসাময়িক দৃষ্টিভঙ্গির দিকে - রাউটলেজ, ২০০৬ - পৃষ্ঠা ৭৯-৮০]

  • আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কিছু আয়াতের বিধান রহিত করেছেন, কিন্তু তিলাওয়াতের (কোরআনের অংশ হিসেবে) বিধান রহিত করেন নি 

  • আবার কিছু আয়াতের বিধান ও তিলাওয়াত (কোরআনের অংশ হিসেবে) দুটোই রহিত করে দিয়েছেন 

  • আবার কিছু আয়াতের বিধান রহিত করেননি কিন্তু তিলাওয়াত (কোরআনের অংশ হিসেবে) রহিত করেছেন।

পূর্বে শুধু বিধান রহিত হওয়ার বেশ কিছু রেফারেন্স পেশ করেছিলাম, এখন শুধু তিলাওয়াত রহিত হওয়ার কিছু তথ্য উপস্থাপন করি, যেমন হাদিসে এসেছে -

আনাস (রা) বর্ণনা করেছেন যে, কিছু আয়াত আমরা পাঠ করতাম। অবশ্য পরে এর তিলাওয়াত রহিত হয়ে যায়। [বুখারি ৪০৯০]

আরেক হাদিসে পাওয়া যায় রজমের হুকুম কোরআনের আয়াত হিসেবে বর্ণিত হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে তার বিধান কায়েমের হুকুম রহিত না হলেও তিলাওয়াতের (কোরআনের অংশ হিসেবে) হুকুম রহিত করা হয়েছিল। [সহিহ মুসলিম ১৬৯১; আবু দাউদ ৪৪১৮; মুসনাদে আহমদ ৩৫২, ৩৯১]

কয়বার দুধ পান করালে দুধ সম্পর্কিত সম্পর্ক স্থাপন হবে সেই বিষয়েও কোরআনের আয়াত নাজিল হয়েছিল। কিন্তু তার বিধান কায়েমের হুকুম পরবর্তীতে রহিত না হলেও তিলাওয়াতের (কোরআনের অংশ হিসেবে) হুকুম রহিত করা হয়েছিল। [সহিহ মুসলিম ১৪৫২; মুয়াত্তা মালিক ১২৮৪]

এছাড়া কোরআনের বাহিরে রাসুলের উপর যে ওহি আসতো সেগুলো কোরআনের অন্তর্ভুক্ত করাও যেত না, কারণ তার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন আল্লাহ। [সূরা আন আম আয়াত ৩৪, ১১৫; সূরা কাহফ আয়াত ২৭; সূরা রাদ আয়াত ৪১] কোনটা স্পেশালি কোরআনের ওহি তা আলাদা ভাবে জানানো হত বা রাসূল নিজেই জেনে যেতেন।


বিধান ও তিলাওয়াত উভয় রহিত হওয়ার প্রমান হল সূরা আহযাবের প্রায় ২০০ আয়াত রহিত হওয়া [দুররুল মানসুর ৫/১৮০; আল ইতকান ২/২৫; সহিহ ইবনে হিব্বান ৪৪২৮], সুরা খাল এবং সুরা হাফদ রহিত হওয়া [আল ইতকান – সুয়ুতি ২/৬৬; আদওয়াউল বায়ান (২/৪৫১)]

ইবনে আতিয়াহ (রহঃ) বলেন:

সম্পূর্ণ রহিত করা হয় যখন আয়াত এবং হুকুম উভয়ই রহিত হয়, যার অনেক উদাহরণ রয়েছে। এছাড়াও, আয়াত রহিত হতে পারে কিন্তু বিধান নয়, বা বিধান রহিত হতে পারে কিন্তু আয়াত নয়। আয়াত ও হুকুম দুটি ভিন্ন জিনিস; কখনো কখনো তাদের একটি বাতিল হতে পারে কিন্তু অন্যটি নয়। [আল-মুহাররর আল-ওয়াজিজ, ১/১৩১]


উপসংহার


আমরা আগেই দেখেছি কোরআনে আল্লাহ বলেছিলেন তিনি যা ইচ্ছা মিটিয়ে দেন, ভুলিয়ে দেন, বা রহিত আয়াতের পরিবর্তে সমপর্যায়ের বা উত্তম আয়াত আনয়ন করেন। তাই কোন আয়াত যদি পরবর্তীতে কোরআন থেকে সরিয়ে ফেলা হয়ে থাকে তাহলে তা নিয়ে এত বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই, কারণ আল্লাহ আগেই বলেছিলেন তিনি এমনটা করবেন প্রয়োজনে। আর এসবের পিছনে হিকমতগুলো সম্পর্কে আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন, তারপরও আপনারা নিজ থেকে একটু চিন্তা করলেও হয়তো কিছুটা উপলব্ধি করতে পারবেন অথবা এর পিছনে ওলামাদের বিচার-বিশ্লেষণ করা কিছু হিকমা-প্রজ্ঞা সম্পর্কে দেওয়া তথ্যগুলো দেখতে পারেন।


এই হতেতো স্পষ্ট হয়ে গেল আল্লাহ যে বলেছিলেন, ‘তিনি যা ইচ্ছা রহিত করেন, আল্লাহর যা ইচ্ছা তিনি তা করেন, যা ইচ্ছা বিধান দেন’ তিনি নিজের সেই কথা মতই কাজ করেছেন। কিন্তু তারপরও মুর্খরা এসব রহিত হয়ে যাওয়া জিনিসকে ‘হারিয়ে যাওয়া আয়াত’ নাম দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালায়। আশা করি এই লিখা হতে এই বিষয়ে সমস্ত সমস্যার সমাধান পেয়ে যাবেন ইনশাল্লাহ

Post a Comment

0 Comments