বিবর্তনবাদ - ২



লেখক:- সাব্বির আহমেদ

বিবর্তনবাদী নাস্তিক ও বস্তুবাদীদের কাছে ডারউইনবাদ ও বিবর্তন একই কারণ তাদের কাছে ডারউইনবাদের মূল কন্সেপ্টের কোনো প্রমাণ নেই। আসুন দেখা যাক ডারউইন ইভল্যুশন ও ইভল্যুশনের মূল পার্থক্য ও নাস্তিকদের দেয়া প্রমাণ--


বিবর্তন কী? ব্যাপক অর্থে যেকোনো ধারাবাহিক পরিবর্তনই বিবর্তন। সেটা যেমন জীবজগতে হতে পারে তেমনি হতে পারে সভ্যতা-সংষ্কৃতির যেকোনো ক্ষেত্রে। জীবজগতের মধ্যে সেই বিবর্তন হচ্ছে জীবদের মধ্যে ভেরাইটি তৈরি হওয়া। কিন্তু ডারউইনবাদের মূল কন্সেপ্ট তা নয়।


ডারউইনবাদ কী? অক্সফোর্ড কন্সাইজ সায়েন্স ডিকশনারি অনুযায়ী-- "বিবর্তন হলো সেই ধারণাবাহিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে আদিম বা প্রাচীনতম জীবসমূহ হতে বর্তমান জীববৈচিত্রের উদ্ভব হয়েছে, যা তিনশো কোটি বছর ধরে চলছে অনুমান করা হয়।"


তাহলে ডারউইনবাদ অনুসারে

"তিনশো কোটি বছর থেকে কোনো এককোষী প্রাণী থেকে র‍্যান্ডম মিউটেশনের ও ন্যাচারাল সিলেকশনের মাধ্যমে বর্তমান জীববৈচিত্র উৎপত্তি লাভ করে।"

 ডারউইনবাদ বিশ্লেষণ করলে তিনটি পৃথিক আইডিয়া পাওয়া যায়--

 

১। র‍্যান্ডম মিউটেশন 

২। ন্যাচারাল সিলেকশন 

৩। কমন ডিসসেন্ট।


ডারউইনবাদে তিনটি পৃথক আইডি থাকার জন্য অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন। কারণ তিনটা একই সাথে ভুল নয়। তিনটা আলাদা আইডিয়া হওয়ায় প্রকৃতিতেই তা কিছুটা দৃশ্যমান যেমন ডারউইন ফিন্স পাখির ঠোটে দেখে উৎসাহিত হয়েছিলেন। তাহলে ভুল কোথায়? সেটাই আলোচনার অন্যতম উদ্দেশ্য।


র‍্যান্ডম মিউটেশনঃ মিউটেশন কী? সাধারণভাবে বললে মিউটেশন হচ্ছে জিনোমের পরিবর্তন। আরেকটু বিস্তারিত বললে, কোষ বিভাজনের সময় ডিএনএও বিভাজিত হয়। যাকে বলা হয় ডিএনএ অনুলিপন। ডিএনএ অর্ধরক্ষণশীল নিয়মে বিভাজিত হয় এর ফলেও প্রজাতিতে কিছুটা ভেরাইটি তৈরি হয়। ডিএনএ চারটি ক্ষার দিয়ে গঠিত -- অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন ও থায়ামিন। ডিএনএ অনুলিপনের সময় মাঝে মধ্যেই ভুল হয় যার ফলে ডিএনএ সিকোয়েন্সে পরিবর্তন আসে। এই ভুলকেই বলা হয় মিউটেশন। কোনো ভুলই কখনো ভাল কিছু নিয়ে আসেনা যদি চমৎকার কিছু না ঘটে। তেমনি মিউটেশনও জীবদেহের জন্য বেশিরভাগ সময় বড় ধরণের ক্ষতির কারণ হয় যা অনেক সময় জীবটির অক্কার কারণও হতে পারে। আবার অনেক মিউটেশন আছে কোনো প্রভাব ফেলেনা। কিছু মিউটেশন উপকারী হয় যা খুবই রেয়ার। আবার এমনও হতে পারে সেই ভুল তার পরবর্তী জেনারেশনে প্রকাশ পেতে পারে। এতে কিছু উপকারী মিউটেশন দেখিয়ে বস্তুবাদীরা বলে এটা ডারউইনবাদের প্রমাণ। চিন্তা করুন এই বিশাল জীবজগৎ বিবর্তিত হয়েছে রেয়ার কিছু মিউটেশনের ফলে। এই রেয়ার মিউটেশনের ফলে এককোষী ব্যাকটেরিয়া বহুকোষী হয়ে, চোখ, হাত, পা গজিয়ে আজকের এই জীববৈচিত্র! তাদের এই যুক্তি কতটা অমূলক তা কমন সেন্স দিয়ে চিন্তা করলেও স্পষ্টভাবে বুঝা সম্ভব। উপরে আগেই দেখেছি ডিএনএ অনুলিপনের সময় ডিএনএ সিকোয়েন্সে কিছুটা পরিবর্তন আসে মানে ডিএনএ সিকোয়েন্স রিকম্বিনেশন হয় কিন্তু তা নতুন কোনো ফাংশনাল তথ্য যোগ করেনা। যা থেকে ব্যাকটেরিয়া বহুকোষী হয়ে চোখ, হাত ও পা তৈরি হয়ে মাছ বা অন্য কোনো প্রাণীতে বিবর্তিত হবে। এখন পর্যন্ত এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, এককোষী থেকে বহুকোষী হয়েছে। এইসব প্রশ্নে বস্তুবাদীরা কোটি কোটি বছরের সীমারেখা দাঁড় করিয়ে থাকে। কিন্তু এই সময় ও রেয়ার মিউটেশন কি বায়োডাইভারসিটি ব্যাখ্যা করতে পারবে? পারবেনা। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা সহজেই বুঝা যায়-- ব্যাকটেরিয়া প্রতি ২০ বা ৩০ মিনিটস পর পর রিপ্রোডইউস করে থাকে। ফলে তাদের মিউটেশন ঘটার সম্ভাবনাও অনেক বেশি। বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট থেকে দেখা যায়-- ব্যাকটেরিয়া এন্টিবায়োটিক রিজিসট্যানস তৈরি করে ১ ইন ১০^১২ ও ১^২০। ব্যাকটেরিয়ার রয়েছে লার্জ পপুলেশন সাইজ ও রিপ্রোডইউস করা প্রচুর সুযোগ। কিন্তু এটা যদি ম্যামলস ও মানুষের ক্ষেত্রে হিসেব করা হয় তাহলে বিবর্তনের জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবেনা। কারণ আমরা ২০ বা ৩০ বছর পর রিপ্রোডিইউস করে থাকি ও আমাদের পপুলেশন সাইজও অনেক কম। অতএব বিবর্তনের জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যাবেনা। মিউটেশনের মাধ্যমে একটা এন্টিবায়োটিক রিজিসট্যানস তৈরি হতে যদি এই অবস্থা হয় তাহলে ফাংশনাল অঙ্গ তৈরি হয়ে এই বিশাল জীববৈচিত্র্য বিবর্তিত হওয়াও অসম্ভব ব্যাপার। বস্তুবাদীরা এন্টিবায়োটিকের মত দু'একটা উপকারী মিউটেশন দেখিয়ে বলে বিবর্তনবাদ প্রমাণিত হয়েছে। যা কতটা অযুক্তিক! যদি দু'একটা উপকারী মিউটেশন দিয়ে বিবর্তনবাদ প্রমাণিত হয় তাহলে অসংখ্য ক্ষতিকর মিউটেশন দিয়েও বিবর্তনবাদ ভুল প্রমাণিত হয়। কারণ নগণ্য মিউটেশন বায়োডাইভারসিটি ব্যাখ্যা দিতে পারেনা। কয়েকটা স্টাডি থেকে দেখা যায়- মিউটেশনের ফলে ৬০০০ উপরে জেনেটিক্স ডিসঅর্ডার সৃষ্টি হয়েছে। রয়েছে এপিজেনেটিক্স ও জিন রেগুলেটরি নেটওয়ার্ক সিস্টেম যা প্রমাণ করে সামন্য একটি মিউটেশনও জীবের জন্য বিশাল ক্ষতির কারণ হতে পারে। একটি পয়েন্ট মিউটেশন সৃষ্টি করতে পারে মরণঘাতী ক্যান্সার। সেখানে র‍্যান্ডম মিউটেশনের ফলে নতুন ফাংশন সৃষ্টি হওয়াও দুর্বোধ জটিল।


ন্যাচারাল সিলেকশনঃ ন্যাচারাল সিলেকশন কী? ন্যাচারাল সিলেকশন বলতে বুঝায়-- পরিবর্তিত পরিবেশে যোগ্যতমরা টিকে থাকবে ও অযোগ্যরা বিলুপ্ত হবে এবং বেঁচে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো পরবর্তী জেনারেশন প্রাপ্ত হবে। এই প্রক্রিয়া যত সময় ধরেই চলতে থাকুক না কেন তা ব্যাকটেরিয়া থেকে মাছ বা অন্যকোনো পরিবর্তিত হবেনা। কারণ তা ফাংশনাল কোনো অঙ্গ তৈরি বা নতুন তথ্য যোগ করেনা। একটা উদাহরণ দেখা যাক- ডাইরিয়ায় আক্রান্ত রহিম মিয়া একটি এন্টিবায়োটিক খেলো এতে যেসব ব্যাকটেরিয়া ডাইরিয়ার জন্য দায়ী তাদের জন্য নতুন পরিবেশ সৃষ্টি হলো। এই এন্টিবায়োটিকের বিষক্রিয়া সহ্য করার ক্ষমতা সকল ব্যাকটেরিয়ার জন্য সমান নয়। কিছু ব্যাকটেরিয়া অল্প ডোজেই অক্কা পাবে কিছু এই এন্টিবায়োটিক ক্ষমতা অর্জন করবে। বস্তুবাদীরা এইসব ব্যাকটেরিয়ার রিজিসট্যানস দিয়ে ডারউইনবাদ প্রমাণ দিয়ে থাকেন। কিন্তু ব্যাকটেরিয়া এন্টিবায়োটিক রিজিসট্যানস তৈরি হওয়া মানে কখনোই অন্য প্রাণীতে বিবর্তিত হওয়া প্রমাণ করেনা। কারণ ব্যাকটেরিয়া তার ডিএনএ রিকম্বিনেশন ও অন্য ব্যাকটেরিয়া থেকে ডিএনএ শেয়ারের মাধ্যমে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে যেখানে নতুন কোনো ফাংশনাল তথ্য যোগ করেনা। তাই ব্যাকটেরিয়া থেকে অন্যকোন প্রাণীতে বিবর্তনও অসম্ভব।


মিউটেশন ও ন্যাচারাল সিলেকশনের দুইটা প্রধান সমস্যা হলো- ১। যদি পপুলেশন সাইজ লার্জ হয় তবে একটি মিউটেশনের জন্য সময় হ্রাস করে কিন্তু ন্যাচারাল সিলেকশনের সময় বৃদ্ধি করে। ২। যদি পপুলেশন সাইজ ছোট হয় তবে, একটি মিউটেশনের সময় বৃদ্ধি করে কিন্তু ন্যাচারাল সিলেকশনের সময় হ্রাস করে। সুতরাং ন্যাচারাল সিলেকশন ও মিউটেশন কখনোই বায়োডাইভারসিটি ব্যাখ্যা করতে পারেনা কারণ দুইই অপর্যাপ্ত। আবার তাদের যতই সময় দেয়া হোক না কেন তারা কখনোই অন্য কোনো প্রাণীতে বিবর্তিত হবেনা। এর কোনো প্রমাণ নেই।


কমন ডিসসেন্টঃ বিগত উনিশ শতক ও বিশ শতকের শুরুর দিকে মনে করা হতো মিউটেশন ও ন্যাচারাল সিলেকশনে ভুল রয়েছে কিন্তু কমন ডিসসেন্ট সঠিক। প্রমাণ হিসেবে দেখানো হতো ডিএনএ সিকোয়েন্সের ও বাহ্যিক সাদৃশ্য। তৈরি করা হয় বিবর্তনবাদের গাছ। কাকে কোন ডালে রাখা হবে সেটা নিয়ে চলে জোড় প্রচারণা যা তৈরি করা হয় ডিএনএ সিকোয়েন্স ও বাহ্যিক সাদৃশ্য দিয়ে। কিন্তু সেখানেও থাকতো গোঁজামিল যেমন-- ফ্রুট ফ্লাইয়ের ৪৪%, কলা ৫০%, ইঁদুর ৯০% ও শিম্পাঞ্জির সিমিলারিটি ৯৮% তাহলে গাছের ডাল হওয়া উচিত -- ফ্রুট ফ্লাই- কলা- ইঁদুর- শিম্পাজি- মানুষ। কিন্তু সেটা করা হয়নি। শুধু তাই নয় নন- কোডিং ডিএনএ দিয়ে প্রচার শুরু হলো এইসব জাষ্ক ডিএনএ বিবর্তনের ধারায় রয়ে গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা ভুল বলে প্রমাণ হয়। কারণ যাকে জাষ্ক ডিএনএ বলা হতো তা জাষ্ক ডিএনএ নয় বরং তার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তেমনি ডিএনএ সিকোয়েন্সের প্রমাণও ভুল প্রমাণিত হয়। কারণ তখন মনে করা হতো জিন ওয়ান টু ওয়ান কাজ করে এবং একটা জিন একটা প্রোটিন কোড করে কিন্তু না সেটা ভুল। একটা জিন একাধিক প্রোটিন কোড করতে পারে। একই জিন একশো বা হাজারটা প্রোটিন তৈরি করতে পারে alternative splicing- এর মাধ্যমে। আবার একটা প্রোটিন বিভিন্ন কাজ করতে পারে ও আলাদা ফাংশন তৈরি করতে পারে এবং অনেকগুলো প্রোটিন একসাথে একটা ফাংশন তৈরি করতে পারে। এই জন্য একটা প্রাণীর গঠন এতটা সুনির্দিষ্ট, সূক্ষ্ম ও জটিল গঠনের হয়ে থাকে যার ফলে মিউটেশন বেশিরভাগ ক্ষতিকর হয়। ঠিক তেমনি যদিও আমাদের ও শিম্পাঞ্জীর ডিএনএ সিমিলারিটি ৯৮% তথাপিও আমারা তাদের চেয়ে অনেক ভিন্ন। কারণ তাদের চেয়ে আমাদের প্রোটিন ৮০% ডিফারেন্ট। ডিএনএ প্রোটিন তৈরি করে প্রোটিনই জীবের সকল কাজ ও ফাংশন তৈরি করে। তাই সিকোয়েন্স কখনোই বিবর্তনবাদ প্রমাণ করেনা।


সর্বশেষে বলবো, তিনটা আলাদা আইডিয়ায় কোনো একটা প্রমাণ পাওয়া মানেই সম্পূর্ণ ডারউইনবাদ প্রমাণ হয় না। প্রাণীর ভেরিয়েশন থাকা মানেই অন্ধ প্রক্রিয়ায় তৈরি হওয়া নয়। কারণ স্রষ্টা প্রায় প্রতিটা প্রাণীতে দিয়েছেন রিপ্রোডাকশনের ক্ষমতা। ভেরিয়েশন তৈরির ক্ষমতা। দিয়েছেন জিনোম কিছুটা পরিবর্তনের ক্ষমতা ও এপিজেনেটিক ম্যাকানিজম। যা কোনোই অন্ধ কোনো প্রক্রিয়ায় সম্ভব নয়, ব্যাকটেরিয়া থেকে মানুষের বিবর্তনও সম্ভব নয়। নাস্তিকরা প্রমাণ ছাড়া বিশ্বাস করেনা। কিন্তু বিবর্তনের প্রমাণ ব্যতীতই ইহা বিশ্বাস করে।

Post a Comment

0 Comments