Author: Ashraful Nafiz
প্রশ্নঃ একজন মুসলিম সব খারাপ কাজ করে কিন্তু ইসলাম অনুসারে সে সব কাজের ফল পেয়ে বেহেস্তে যাবে। একজন অমুসলিম পৃথিবীতে কারো বিন্দুমাত্র ক্ষতি করেনি, যত উপকার আছে সবই করল। কিন্তু সে চির জাহান্নামি। এটিকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
উত্তরঃ
আপনি যেহেতু এই প্রশ্নটি করছেন সেহেতু আশা করি ধরেই নিচ্ছেন ইসলামই সত্য, কারণ ইসলামকে সত্য না মানলে এই ধর্মে কাকে জান্নাতে দিবে বলেছে, কাকে জাহান্নামে দিবে বলেছে সেইটা দেখিয়ে মানবতা, মানবিকতা, ভালো-খারাপের বিচার করতে গিয়ে তা নিয়ে মাথা ঘামিয়েতো কোন লাভ আছে বলে মনে হয় না। কারণ ইসলামকে সত্য না মানলে এখানের জান্নাত-জাহান্নামকেও আপনি সত্য মানছেন না, আর যেটাকে সত্য মানছেনই না সেটাতে কে যাবে আর কে যাবে না এই চিন্তা বা প্রশ্ন নিছক বোকামি ও সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ আপনার মতেই কেউ জান্নাতিও হবে না আবার কেউ জাহান্নামিও হবে না।
আপনি ইসলামকে সত্য ধরে নিচ্ছেন বা নিয়েছেন এই চিন্তা করেই ও এর ভিত্তিতেই উত্তর দিচ্ছি, কারণ আপনি যদি ইসলামকে সত্য না মনে করেন তাহলে কে ইসলাম মতে জান্নাতি বা জাহান্নামি তা চিন্তা করা বা তা নিয়ে টেনশন করা মূল্যহীন, কারণ আপনার মতে আপনিও জাহান্নামী না ও আপনার কোন অমুসলিম বন্ধুও জাহান্নামী না। তাই কোথায় কী লিখা আছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামিয়েও কোনো লাভ থাকে না আর। যাইহোক উত্তরে আসি।
ধরেন আমাকে পাঠানো হল দুই শহরের মাঝে যে নদী রয়েছে তার উপর ব্রিজ তৈরি করে দুই শহরে মানুষের মধ্যে যাতায়াত, সংযোগের ব্যবস্থা করে দিতে। এটা হচ্ছে আমার দায়িত্ব, আমার মেইন প্রায়োরিটি, এটা করলে দুই জায়গার মানুষই অসংখ্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবে, একটা দীর্ঘ স্থায়ী বা পারমানেন্ট উপকার তারা পাবে। কিন্তু আমি সেটা না করে কী করলাম? আমি দুই শহরে বিভিন্ন এতিম খানা তৈরি করলাম, বড় বড় কোম্পানি তৈরি করলাম, রেস্টুরেন্ট দিলাম, বহু মানুষকে চাকরি দিলাম, হাসপাতাল বানালাম ইত্যাদি।
আমাকে যে কাজের জন্য পাঠানো হয়েছে তা না করে আমি বাড়তি কাজ যেগুলো করলাম তা কি সঠিক ছিল, উচিত ছিল? সবই ভালো কাজই করেছি, কিন্তু কোনটা বেশি প্রয়োজন ছিল তাদের? ব্রিজ নাকি অন্য যেগুলো করলাম সেগুলো? অবশ্যই ব্রিজ বেশি প্রয়োজন ছিল। ব্রিজটা হয়ে গেলে বাকিগুলোও তারা নিজ থেকে করতে বেশি সময় আর লাগতো না হয় তো। এখন আমি যে বাড়তি ভালো কাজগুলো করলাম সেগুলোর জন্য আমাকে ক্ষমা করে বাহ বাহ দেওয়া উচিত নাকি আমাকে যে আসল দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সেটা না করায় শাস্তির আয়ওতায় আনা উচিত? আমি যদি মেইন কাজটা শেষ করে তারপর অন্যগুলো করতাম তাহলে কোন আপত্তি থাকতো না, কিন্তু মেইন কাজটা না করে আলগা পিরিতি দেখিয়ে অন্য কাজ গুলো করে কি ফায়দা?
ড. জাকির নায়েক হাফি. একটা যুক্তি দিয়েছিলেন, সেটাতো আশা করি জানেনই। তারপরও আবারও রিপিট করছি, একটু পার্থক্য হল আমি শুধু একটা বাস্তব উদাহরণ দেওয়ার মাধ্যমে সেটা রিপিট করছি। সম্ভবত গত বছর কোন এক ssc এর ছাত্র মানবিক বিভাগে সব বিষয়ে A+ পেয়েছিল, কিন্তু কোন এক কারণে সে গণিতে ফেল করে, কেন করেছিল সেটা আমার জানা নেই। এই নিউজটা বেশ ভাইরাল হয়েছিল, তার রুল, রেজিস্ট্রেশন, মার্কশিট সহ সেটা অনেকে প্রচার করেছিল। হয়ত আপনারাও জেনে থাকতে পারেন। এখন প্রশ্ন হল, সে সবগুলোতে A+ পেয়েছে বিধায় সেটা বিবেচনা করে কি তাকে উত্তীর্ণ করা উচিত নয়? যদি তাকে উত্তীর্ণ করা হয় তাহলে তা কি সঠিক হবে? যদি বলেন না, তাহলে কেন হবে না? সেওত সবগুলোতে A+ পেয়েছে যেমনটা অমুসলিমরা ভালো কাজ করেছে? সেতো শুধু একটাতে ফেল করেছিল, যেমন অমুসলিমরা মুসলিম হয়নি, তাতে কি তাকে উত্তীর্ণ করে দেওয়া উচিত নয়? হয়ত বলবেন না।
আল্লাহ আমাদেরকে তার ইবাদত করার জন্য পাঠিয়েছেন, তাই আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে ইসলাম গ্রহণ করা, যেমনটা প্রথম উদাহরণে ছিল ব্রিজ তৈরি করা, দ্বিতীয় উদাহরণে ছিল পাশ করা। ইসলাম গ্রহণের পর হল বাকি ইবাদতের কাজগুলো করা যেমন ১ম উদাহরণে ব্রিজ তৈরির পর অন্য কাজগুলো করা, ২য় উদাহরণে ছিল পাশ করার পর ভালো নাম্বার পাওয়া। ইসলাম গ্রহণ ছাড়া ইবাদতের কোন মূল্য নেই, যেমন সবগুলোতে পাশ করা ছাড়া বেশ কয়েকটাতে ভালো নাম্বার পাওয়ার কোন মূল্য নেই, আমাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেটা শেষ করা ছাড়া অন্য কাজের কোন মূল্য নেই। আপনি ইসলাম গ্রহণের পর ভালো কাজ করলে অমুসলিমরাও আপনার ও আপনার দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট হবে ও সত্য ধর্ম ইসলাম গ্রহণের প্রতি আগ্রহী হবে, যেমন পাশ করার পর ভালো নাম্বার পাওয়ার আগ্রহ বেড়ে যায়, যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তা পালন করার পর সবাই সন্তুষ্ট হয়, উপকার হয় ও সবাই সেটার কারণে ভালো কিছু করার সুযোগ তৈরি হয়।
এখন হয়ত বহু গোঁজামিল দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন যে এগুলোর সাথে আখিরাতের তুলনা যৌক্তিক নয়। আমি যদিও অযৌক্তিক বলব না কিন্তু আমিও এটা বলি যে আখিরাতের সাথে কোন কিছুর প্রপার তুলনা করা সম্ভব না। কারণ আখিরাত আখিরাতই। কিন্তু উপলব্ধি করার জন্য উদাহরণ গুলো যথেষ্ট মনে করি।
আর অমুসলিমদের যারা জাহান্নামী হবে তাদের বিষয়ে আল্লাহ কোরআনেই বলেছেন তাদেরকে সতর্ক করুক বা না করুন, আল্লাহর প্রত্যেকটি নিদর্শন দেখলেও, সৎপথ দেখলেও তারা ইমান আনবে না। [সুরা বাকারা আয়াত ০৬ ; সূরা আরাফ সুরা আরাফ ১৪৬; সুরা ইয়াসিন আয়াত ১০; সুরা নিসা আয়াত ৪৬, ১১৫]
এসব আয়াত পড়লে এটাই বোঝা যায় যে আল্লাহ তাদেরকে কোটি কোটি বছর এমনকি সারা জীবন বাচিয়ে রাখলেও তারা ইমান আনতো না। বরং দিন দিন তাদের শিরক কুফর এর মতো ভয়াবহ পাপ আরও বৃদ্ধি পেত। তারা কখনও তাওবা করতো না।
আর আল্লাহ যেহেতু জানেন ভবিষ্যতে কি হবে না-হবে কি ঘটবে না ঘটবে, সেহেতু তিনি এটাও জানেন যে কে ভবিষ্যতে ইমান আনবে কে ইমান আনবে না। তাই আল্লাহ সেসব কlফির ও মুশরিক দের চিরস্থায়ী জাহlন্নামে শাস্তি দিবেন, যারা মৃত্যুর আগে তাওবা করে তাদের পাপের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই-নি অথবা ইসলাম সম্পর্কে জেনেও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নি।
অমুসলিমরা জাহান্নামি কেন এই বিষয়ে জবাব দিতে গিয়ে হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলি থানবী (রহ) আশরাফুল জওয়াবে ১ম খণ্ডের ৪৬ পৃষ্ঠা হতে ৪৭ পৃষ্ঠায় বিস্তর আলোচনা করেছেন। সেখান থেকে ২টো পয়েন্ট উল্লেখ করছি।
১. প্রথম পয়েন্ট পৃথিবীতে আমরা নির্ধারিত সময়ের জন্য গুনা করি তাহলে অনির্ধারিত সময়ের জন্য কেন শাস্তি দেওয়া হবে? এর জবাব তিনি দিয়েছেন অনেকটা এই ভাবে, ‘একজন ব্যক্তি যদি দুই ঘণ্টা ডাকাতি, মারামারি, কাটাকাটি, খুন, ধর্ষণ করে তাহলে সে ব্যক্তিকে কি দুই ঘণ্টার জন্য গ্রেপ্তার করে শাস্তি দেওয়া হয় নাকি নির্দিষ্ট কিছু নিয়মে, পদ্ধতিতে শাস্তি দেওয়া হয়?
দুনিয়ার ক্ষেত্রেই যত সময় নিয়ে কেউ অপরাধ করে শুধু ততটুক সময় নিয়েই অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হয় না বরং যতটুকু শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন বা যোগ্য ততটুকুই দেওয়া হয় বা দিতে হয়। অল্প সময়ের জন্য এত বেশি সময় শাস্তি দেওয়া নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলে তারা ধরেই নিচ্ছে শাস্তি দেওয়া হয় ঘণ্টা হিসাবে অথচ দুনিয়াতেই সময় হিসেবে শাস্তি দেওয়া হয় না তাহলে আখিরাতে কেন সময় হিসেবে শাস্তি দিবে! দুনিয়া ও আখিরাতে শাস্তি দেওয়া হয়ই অপরাধ কত বড়, অপরাধের ধরনের উপর ভিত্তি করে, সময়ের উপর ভিত্তি করে না।’
২. দ্বিতীয় পয়েন্টে আমরা যেই বিষয়টা আগে কোরআন হতে আল্লাহ যা বলেছেন দেখেছি সেটাকেই তিনি নিজের মত করে উল্লেখ করেছেন যে, ‘একজন কাফের মৃত্যুবরণ করবে, সে জানে মৃত্যুর পর জান্নাত-জাহান্নাম রয়েছে, তারপরও ইমান আনল না তাহলে তাকে চিরস্থায়ী জাহান্নামে রাখলে সমস্যা কোথায়? ধরলাম কোন ব্যক্তি ৭০ বছর বয়স পেয়েছে, তথাপি সে জানে সময় শেষ হয়ে যাবে, তারপর সে মারা যাবে, জান্নাতে যাওয়ার সুযোগ হারিয়ে ফেলবে এবং চিরস্থায়ী কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে তারপরও সে ইমান আনে নি, তাহলে এই ব্যক্তিকে যদি অনন্তকাল জীবন দেওয়া হয় তাহলে কি সে ইমান আনবে? কখনোই না। যে ব্যক্তি ৬০/৭০ বছর বয়স পেয়ে ও সবকিছু জানা সত্ত্বেও ইমান আনে নি সেই ব্যক্তিকে যদি আরো লম্বা সময়ও দেওয়া হয় তাহলেও সে ইমান আনবে না। তাহলে যেই ব্যক্তি কখনোই ইমান আনবে না, তার নিয়তের উপর সে সর্বদাই অটল থাকবে তাহলে সেই ব্যক্তিকে চিরস্থায়ী শাস্তি দিবে নাতো দিবে কি?’
[থানবী (রহ) এর কথা সালিম আফাহুল্লাহ বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে উল্লেখ করেছেন যেন সবাই সহজে বুঝতে পারে]
হয়ত বলতে পারেন যারা ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারে নি, দাওয়াত পায় নি, সবসময় শুধু মিথ্যাটাই জেনেছে তাদের কি দোষ? এর উত্তরে কিছু বাড়তি তথ্য দিয়ে রাখি, হয়ত কাজে লাগতে পারেঃ-
কোরআনে আল্লাহ বলেছেন তিনি কোন জাতীর কাছে নবী-রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত তাদেরকে শাস্তি দেন না, ধ্বংস করেন না। [সূরা আল-ইসরা, আয়াত ১৫; সূরা আল-কাসাস, আয়াত ৫৯; সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত ১১৫]
তিনি সব ভাষাভাষীর মানুষের কাছে নবী পাঠিয়েছেন, যেন কোন জাতি এই যুক্তি দিতে না পারে যে তাদের কাছেতো সতর্কবার্তা কেউ আনেনি। [সূরা ইবরাহীম, আয়াত ৪]
রাসূল (সা) বলেছেন, “ঐ সত্ত্বার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, এ উম্মাতের কোনো ইয়াহূদী বা নাসারা আমার কথা শুনে [তারপরও যদি] আমার আনিত বিষয়সমূহের প্রতি ঈমান আনয়ন না করে মারা গেলে সে জাহান্নামের অধিবাসী হবে।” [মিশকাতুল মাসাবিহ হাদিস ১০]
রাসূল এখানে বলেন নি যে তিনি আসার পর সব অমুসলিম জাহান্নামি হবে, তিনি বলেছেন যারা উনাকে শুনেছে, তারপরও গ্রহণ করে নি তারা জাহান্নামি হবে।
একটি হাদিসে রাসূল এটাও বলে দিয়েছে যারা কখনো ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারে নি, তাদেরকে আল্লাহ আখিররাতে পরীক্ষা করবেন, সেখানে তারা উত্তীর্ণ হলে জান্নাত পাবে আর উত্তীর্ণ না হতে পারলে জাহান্নাম। [সিলসিলা সহীহাহ ১৪৩৪]
ওলামাগণও বলেছেন যারা কখনো ইসলামের দাওয়াত পায় নি তাদেরকে আখিরাতে পরীক্ষা করা হবে। পরীক্ষা করা হবে কারণ তাদেরদের কাছে দাওয়াত পৌঁছায়নি তবুও তাদেরকে জাহান্নামে পাঠানো তাদের উপর জুলুম, আবার যদি তাদেরকে বিনা হিসাবে জান্নাতে পাঠানো হয় তাহলে তা জান্নাতবাসী যারা কষ্ট করে, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে জান্নাত লাভ করেছে তাদের সাথেও ন্যায়বিচার হবে না। [মাজমুউল-ফাতাওয়া' ৪/২৪৬-২৪৭; মাকতাবাহ মাআরিফ ৩/২০৭]
আরো কিছু ওলামা বিষয়টাকে আরো পরিষ্কার করে বলেছেন যে, আর যারা ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জানে নি, বা দাওয়াত পায় নি কখনো বা সব সময় নেগেটিবই জেনেছিল তাদের বিষয়ে ওলামাদের মত হচ্ছে তারা ওজর প্রাপ্ত। তাই তাদের ক্ষেত্রে সরাসরি জাহান্নামি বলা সম্ভব না। [ফায়সালুত তাফরিকা, পৃষ্ঠা ১০৪-৫, দারুল মিনহাজ; তরিকুল হিজরাতাইন, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৮৯৯-৯০২; হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা, ১/২৪৫-৬]
কিন্তু একটা বিষয় উল্লেখ্য যে, কেউ মুসলিম হল, ইমান আনল, কালেমা পড়ল এতেই সে প্রকৃত মুসলিম হিসেবে গণ্য হয়ে যায় না। অন্তত সকল প্রকার শিরক থেকে তাকে দূরে থাকতে হবে, সকল প্রকার কুফুরি হতে তাকে দূরে থাকতে হবে। তারপর কোন গুণা করলে সে পাপের শাস্তি ভোগ করার পর তাকে জান্নাত দান করা হবে। কিন্তু যদি সে মুসলিম হয়েও জেনেশুনে কুফুরি করে, শিরক করে তাহলে তার মুসলিম হয়েও কোন লাভ নেই, তাকে জাহান্নামেই থাকতে হবে।
0 Comments