ইসলামে নারী কি পুরুষ অপেক্ষা নিম্নতর?



🖋Author:- Ahmed Al-Ubaydullaah
____________________________________________________________________________________
.
.
[বিঃদ্রঃ ইসলামে নারীর অবস্থান বুঝতে যদি মুসলিম সমাজের দিকে তাকান, তবে আপনি হয়ত কিছুই ঠিকমত বুঝতে পারবেন না। কারণ বর্তমান মুসলিম সমাজ ক্রমাগত কুরআন ও সুন্নাহ হতে দূরে সরে যাচ্ছে! বর্তমানের মুসলিম সমাজের একাংশের মধ্যে আপনি দেখবেন যে, নারীর তেমন কোনো মর্যাদাই নেই। তাকে পুরুষ ইচ্ছামত লাঞ্ছিত, অপমানিত করে চলেছে। অন্য অংশে হয়ত দেখবেন, নারী নিজেকে আধুনিক দাবি করে স্বেচ্ছাচারিতায় মেতে উঠে নিজেই যেন সর্বেসর্বার রূপ ধারণ করেছে! খুব কম ক্ষেত্রই হয়ত আপনি পেতে পারেন যেখানে পুরুষ ও নারীর সঠিক ইসলামিক অবস্থান আপনার নজরে পড়বে। কিন্তু এই সঠিক অবস্থান নজরে আসার জন্যও আপনার জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক হওয়া প্রয়োজন। যদি আপনি এটাই ঠিকমত না বোঝেন যে, ইসলামে নারীর সঠিক অবস্থান আসলে কী, তবে ভুল দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামকে বিচার করতে আসায় পদে পদে আপনি বিভ্রান্তির স্বীকার হবেন। একারণে ইসলামে নারীর অবস্থানকে বুঝতে কুরআন ও হাদিস প্রদর্শিত পথেই একে বুঝতে হবে, যে পথে হেঁটেছেন নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং সালফে সালেহীনগণ। যেহেতু নারী ও পুরুষের অবস্থান নিয়ে আলোচনা একটি ব্যাপক বিষয় এবং এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে গোটা একটি অথবা অনেকগুলি পুস্তক রচিত হয়ে যাবে, সেহেতু এই লেখনিতে সংক্ষিপ্ত আকারে মাত্র কয়েকটি বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করা হল – যা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে সঠিক করার জন্য সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। বিস্তারিতভাবে বিষয়টি বোঝার জন্য পাঠককে অনুরোধ করব সঠিক ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সহিহ মানহাজে নিজের ইলম বৃদ্ধির প্রচেষ্টা করুন। আল্লাহ তাআলা আমাদের ভুল-ত্রুটি মার্জনা করুন এবং সকলকে হেদায়েতের পথে পরিচালিত করুন। আমিন।]
.
.
.
পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মীয় শাস্ত্রে বিশেষ করে পৌত্তলিক শাস্ত্রগুলিতে যুগে যুগে নারীকে পুরুষ অপেক্ষা নিম্নতর জীব হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ইসলামবিরোধীগণ সেই সকল গ্রন্থের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ইসলামকে বুঝতে আসে। ফলে কুরআন ও হাদিসের বিভিন্ন বক্তব্য থেকে তারা সেই একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ইসলামে নারী, পুরুষ অপেক্ষা নিম্নতর।

প্রথমেই এটা বলে নেওয়া উচিৎ যে, আপনি যদি কুরআন-হাদিসকে সামগ্রিকভাবে বিচার করেন, তবে দেখবেন যে, সামগ্রিক বিচারে পুরুষ এবং নারী সমান নয়। তবে পুরুষ ও নারী সমান না হওয়ার অর্থ এটা নয় যে, পুরুষের চেয়ে নারী উত্তম, অথবা নারীর চেয়ে পুরুষ উত্তম। অর্থাৎ লিঙ্গের ভিত্তিতে কোনো শ্রেষ্ঠত্ব ইসলামে নেই। বিষয়টি নিয়ে একটু পরেই বলছি।
তবে এর পূর্বে এটা বলে নেওয়া বাঞ্ছনীয় যে, ইসলামে নারী ও পুরুষ সমান না হওয়া সত্ত্বেও তারা পরস্পর সমতুল্য। বিষয়টি একটি উদাহরণের সাহায্যে বোঝা যেতে পারে।
ধরুন, একটি শক্তিশালী চুম্বক আপনার কাছে রয়েছে। এর উত্তর ও দক্ষিণ মেরু সমানভাবে ক্রিয়াশীল। কিন্তু আপনি এটা বলতে পারবেন না যে, চুম্বকের উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু পরস্পর সমান। কারণ চুম্বকের দুই মেরুর আচরণ, ধর্ম ইত্যাদি ভিন্ন ভাবে কাজ করে। দুটি উত্তর মেরু কাছাকাছি এলে তারা পরস্পর বিকর্ষণ করে।একইভবে দুটি দক্ষিণ মেরু কাছাকাছি এলেও তারা একে অপরকে বিকর্ষণ করে। অথচ একটি উত্তর মেরু ও একটি দক্ষিণ মেরু পরস্পর কাছাকাছি এলে তারা একে অপরকে আবার আকর্ষণ করবে।
তাই আমরা বলতে পারি যে, চুম্বকের উত্তর ও দক্ষিণ মেরু সমান নয়, কিন্তু তারা পরস্পর সমতুল্য। অর্থাৎ এক মেরুর সমতুল্য অবস্থান অপর মেরুর ক্ষেত্রে পাওয়া যায়।
“সমতুল্য” শব্দটিকে আরও একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক। ধরুন, আপনার কাছে ১০০ কেজি চাল আছে আর এক ব্যক্তির কাছে ১০০ পিস মাছ আছে। এখন আপনাদের দুজনের প্রত্যকের কাছেই প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত চাল আর মাছ আছে। এবার আপনারা বিনিময় প্রথার প্রয়োগ করে নির্ধারণ করলেন যে, আপনি ৫ কেজি চাল দেবেন এবং বিনিময়ে মাছওয়ালা আপনাকে ১০ পিস মাছ দেবেন। এখানে আপনারা উভয়েই লাভবান হচ্ছেন। আপনার মাছের চাহিদাও মিটছে এবং মাছওয়ালার চালের প্রয়োজনও পূরণ হচ্ছে। এখানে ৫ কেজি চালের উপযোগিতা ১০ পিস মাছের সমতুল্য। কিন্তু এর অর্থ কি এটা যে, ৫ কেজি চাল আর ১০ পিস মাছ পরস্পর সমান? না! কেননা, প্রথমত দুটি ভিন্ন জিনিস চাল এবং মাছ একই বস্তু নয়। দ্বিতীয়ত, চাল এবং মাছের ওজনও হয়ত এক নাও হতে পারে। তৃতীয়ত চাল ও মাছের সংখ্যা এক নয়; চালের কণার সংখ্যা অগণিত, কিন্তু মাছের পিস এর সংখ্যা সীমিত। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও ৫ কিলো চাল আর ১০ পিস মাছ এখানে একে অপরের সমতুল্য।
একইভাবে চুম্বকের উত্তর ও দক্ষিণ মেরু পরস্পর সমান নয়, কেননা তারা দুটি ভিন্ন মেরু। কিন্তু মেরুদ্বয় পরস্পরের সমতুল্য যেহেতু তারা আদর্শ চুম্বক তৈরিতে একে অপরের পরিপূরক।

উপরের উদাহরণগুলি যদি আপনি বুঝতে সক্ষম হন, তবে আমরা বলব যে, নারী ও পুরুষও এরূপে পরস্পর সমান নয়, কিন্তু তারা পরস্পর সমতুল্য এবং একে অপরের পরিপূরক। লক্ষ্য করুন, নারীর শারীরিক কাঠামো তথা শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপ পুরুষ অপেক্ষা ভিন্নতর। উদাহরণস্বরূপ, পুরুষের তুলনায় নারীর চামড়ার নীচে কিছু অতিরিক্ত চর্বির কারণে নারীর দেহ পুরুষ অপেক্ষা অধিকতর নরম হয়ে থাকে।
নারী ও পুরুষের মনস্তত্ত্ব একে অপরের থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। উদাহরণ হিসেবে, পুরুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার চিন্তায় যৌনতাকে প্রাধান্য দেয়, যেখানে নারী সর্বদা যৌনতা নিয়ে চিন্তা করে না।
নারীর হরমোন জনিত প্রভাব তথা বায়োলজিক্যাল বিষয়সমূহ পুরুষ অপেক্ষা ভিন্নতর। উদাহরণস্বরূপ, নারীর ক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেন, প্রজেস্টেরন প্রভৃতি হরমোনের অধিক নিঃসরণ এবং পুরুষের ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরন হরমোন এর অধিক নিঃসরণ দেখা যায়। ফলতঃ পুরুষের মধ্যে পুরুষালি ভাব ও নারীর মধ্যে নারীসুলভ ভাব প্রকাশ পায়। এছাড়াও নারীর বায়োলজিক্যাল বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতার কারণে তাকে ঋতুচক্র ও সন্তান জন্মদানের মত ক্রিয়াকলাপের সম্মুখীন হতে হয় যা পুরুষের ক্ষেত্রে সাধারণত চোখে পড়ে না। পুরুষের রেচন অঙ্গগুলো নারীর তুলনায় ভিন্নতর হওয়ার পুরুষ ও নারীর রেচন-ক্রিয়ার মধ্যেও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

এরূপ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা দেখি যে, পুরুষ ও নারী ভিন্ন প্রকৃতির। তাই এটাই যুক্তিযুক্ত যে, নারী ও পুরুষ সমান নয়। তবে তারা সমান না হওয়া সত্ত্বেও তারা পরস্পর সমতুল্য, কেননা তারা একে অপরের পরিপূরক। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নারী ও পুরুষের সমতুল্যতাকে এরূপে কুরআনুল কারীমে ঘোষণা করছেন,

“অনন্তর তাদের প্রতিপালক তাদের আহ্বানে সাড়া দিলেন যে, আমি তোমাদের পুরুষ অথবা নারীর মধ্য হতে কোন কর্মীর কৃতকার্য ব্যর্থ করবো না, তোমরা পরস্পর এক…”
[মহাগ্রন্থ আল-কুরআন, ৩:১৯৫; অনুবাদঃ মুজিবুর রহমান]

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তফসীরে আহসানুল বায়ানের এক স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে,
“’নর অথবা নারী’ কথাটি এখানে এই জন্য বলা হয়েছে যে, ইসলাম কোন কোন বিষয়ে নর ও নারীর মধ্যে তাদের উভয়ের প্রাকৃতিক গুণাবলীর কারণে কিছু পার্থক্য করেছে… এই পার্থক্যগুলো দেখে যেন এই মনে ক’রে না নেওয়া হয় যে, নেক কাজের প্রতিদানেও পুরুষ ও মহিলার মধ্যে পার্থক্য করা হবে। না, এরকম হবে না। বরং প্রত্যেক নেকীর যে প্রতিদান একজন পুরুষ পাবে, সেই নেকী যদি কোন মহিলা করে, তাহলে সেও অনুরূপ প্রতিদান পাবে… جملة معتر ضة অর্থাৎ, বাক্যের মধ্যে ব্যাকরণগত সম্পর্কহীন একটি প্রবিষ্ট বাক্য। এই বাক্যের উদ্দেশ্য হল পূর্বোক্ত বিষয়কে আরো পরিষ্কার ক’রে বর্ণনা করা। অর্থাৎ, নেকী ও আনুগত্যে তোমরা পুরুষ ও মহিলা সমান…”
[তফসীরে আহসানুল বায়ান (বঙ্গানুবাদ)/সূরা আল-ইমারানের আয়াত ১৯৫ এর তাফসীর হতে বিবৃত]

বিখ্যাত মুফাসসির ইবনে কাসির (রাহিমাহুল্লাহ) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় অন্যত্র এক স্থানে বলেন,
“…আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সংবাদ দিচ্ছেন, ‘আমি কোন কর্মীর কৃতকর্ম বিনষ্ট করি না। বরং সকলকেই পূর্ণ প্রতিদান দিয়ে থাকি। সে পুরুষই হোক বা মহিলাই হোক। সওয়াব ও কাজের প্রতিদানের ব্যাপারে আমার নিকট সবাই সমান…”
[তাফসীর ইবনে কাসির (অনুবাদঃ মুজিবুর রহমান)/সূরা আল-ইমারানের আয়াত ১৯৫ এর তাফসীর হতে বিবৃত]

তাহলে আমরা দেখছি যে, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট কোনো ব্যক্তি লিঙ্গের কারণে প্রিয় হচ্ছে না। নারী ও পুরুষ উভয়েই মহান আল্লাহর দৃষ্টিতে সমতুল্য।

এখন, পূর্বেই আমরা দেখিয়েছি যে, নারী ও পুরুষের প্রকৃতি ভিন্নতর। সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে এটাই ন্যায়সঙ্গত যে, যার প্রকৃতি যেরূপ, তার কর্তব্যও সেরূপ হবে।
উদাহরণস্বরূপ ধরুন, আপনি এবং আপনার এক বন্ধু দুজনের খাওয়ার চাহিদা এক রকম নয়। আপনি হয়ত এক প্লেট বিরিয়ানি খেতে পারেন যেখানে আপনার বন্ধুর তিন প্লেট না খেলে পেট ভরে না। এখন আপনি যদি এক প্লেটের বেশি খেতেই না পারেন, আর আপনাকে জোর করে ঠেসে তিন প্লেট বিরিয়ানি খাওয়ানো হয়, তবে এটা কি আপনার জন্য আনন্দদায়ক নাকি অস্বস্তিকর? নিশ্চয়ই এটা অস্বস্তিকর, কেননা আপনি এক প্লেট খেয়েই সন্তষ্ট হয়ে যান।
একইভাবে যেটা পুরুষের প্রকৃতির সাথে অথবা নারীর প্রকৃতির সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ নয়, সেই কাজের দায়িত্ব ইসলাম সামাঞ্জস্যপূর্ণ প্রকৃতির বিপরীতে পুরুষ অথবা নারীকে দেয় না। অর্থাৎ যে দায়িত্ব পুরুষের জন্য সামাঞ্জস্যপূর্ণ, ইসলাম সেই দায়িত্ব পুরুষকে দিয়েছে; যে দায়িত্ব নারীর প্রকৃতির সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ, সেই দায়িত্ব নারীকে দেওয়া হয়েছে। আর এই দায়িত্ব-কর্তব্যের প্রসঙ্গ সূত্রে বিভিন্ন স্থানে নারী-পুরুষের অবস্থান বিবৃত হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ কুরআনের এক আয়াতে বলেন,

“পুরুষগণ নারীদের উপর তত্ত্বাবধানকারী ও ভরণপোষণকারী, যেহেতু আল্লাহ তাদের মধ্যে একের উপর অপরকে বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এ হেতু যে, তারা স্বীয় ধন-সম্পদ হতে ব্যয় করে থাকে; সুতরাং যে সমস্ত নারী পুণ্যবতী, তারা আনুগত্য করে, আল্লাহর সংরক্ষিত প্রচ্ছন্ন বিষয় সংরক্ষণ করে…”
[মহাগ্রন্থ আল-কুরআন, ৪:৩৪; তথ্যসূত্রঃ তাফসির ইবনে কাসির (বঙ্গানুবাদ), অনুবাদঃ মুজিবুর রহমান]

এখন আমরা পূর্বেই দেখেছি যে, নারী ও পুরুষ পরস্পর সমতুল্য। কিন্তু এখানে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, পুরুষ নারীর উপর কর্তৃত্বশীল।

তাহলে এই কর্তৃত্বের অর্থ কী?

হাফেয ইবনে কাসির (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, “…পুরুষ হচ্ছে স্ত্রীর সংরক্ষক ও প্রতিপালনকারী। সে স্ত্রীকে সোজা ও সঠিকভাবে পরিচালনাকারী… যেহেতু আল্লাহ তাদের মধ্যে একের উপর অপরকে বৈশিষ্ট্য দান করেছেন…
…দ্বিতীয় কারণ এই যে, পুরুষেরা নারীদের উপর তাদের সম্পদ খরচ করে থাকে, যে খরচের দায়িত্ব কিতাব ও সুন্নাহ্ তাদের প্রতি অর্পণ করেছে। যেমন মোহরের খরচ, খাওয়া পরার খরচ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচ…”
[তাফসীর ইবনে কাসির (অনুবাদঃ মুজিবুর রহমান)/সূরা আন-নিসা আয়াত ৩৪ এর তাফসীর হতে বিবৃত]

সুতরাং আমরা বুঝতে পারি যে, এখানে পুরুষের দুটি প্রধান দিক রয়েছে যে কারণে পুরুষকে নারীর উপর কর্তৃত্বশীল তথা প্রাধান্য প্রদানকারী করা হয়েছেঃ
১) পুরুষ, নারীর অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করছে;
২) পুরুষের ওপর নারীর যাবতীয় খরচ, ভরণপোষণের দায়িত্ব রয়েছে।

এখন এই দুটি দায়িত্বের কারণে যদি পুরুষ নিজেকে সামগ্রিকভাবে নারী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ভাবা শুরু করে, তবে এর জবাবে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অন্যত্র বলেন,

“আল্লাহ তাআলা তোমাদের একজনের ওপর আরেকজনকে যা (কিছু বেশি) দান করেছেন, তোমরা (তা পাওয়ার) লালসা করো না, যা কিছু পুরুষরা উপার্জন করলো তা তাদেরই অংশ হবে; আবার নারীরা যা কিছু অর্জন করলো তাও (হবে) তাদেরই অংশ; তোমরা আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে তাঁর অনুগ্রহ (পাওয়ার জন্যে) প্রার্থনা করো; অবশ্যই আল্লাহ তাআলা প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে সম্যক ওয়াকেফহাল রয়েছেন।”
[মহাগ্রন্থ আল-কুরআন, ৪:৩২; অনুবাদঃ হাফেজ মুনির উদ্দীন আহমাদ]

উক্ত আয়াতে আমরা দেখি যে, মহান আল্লাহ বলছেন “আল্লাহ তাআলা তোমাদের একজনের ওপর আরেকজনকে যা (কিছু বেশি) দান করেছেন…”, অর্থাৎ যদি পুরুষ অথবা নারী যে কোনো ব্যক্তিই কোনো কারণে কিছু বেশি বস্তুগত অথবা অবস্তুগত উপার্জন করে থাকে বা কিছু বেশি সম্মান বা মর্যাদা পেয়ে থাকে, তবে সেটি চূড়ান্তরূপে তার নিজের কৃতিত্ব নয়; বরং যে সম্মান, মর্যাদা ইত্যাদি সে পেয়েছে, সেগুলো মহান আল্লাহই তাকে দান করেছেন। একারণে পুরুষ যখন নারীর অভিভাবক ও ভরণপোষণকারী, তখন এই দায়িত্বের ভিত্তিতে পুরুষের অবস্থান ও মর্যাদার কৃতিত্বও পুরুষের নিজের নয়, যেহেতু এই দায়িত্ব ও মর্যাদা মহান আল্লাহই তাকে প্রদান করেছেন। আর তাই আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করলে সেই সম্মান ও মর্যাদা কেড়েও নিতে পারেন। এহেতু তার গর্ব বা অহংকারের কোনো সুযোগ নেই; যেহেতু তাকে (পুরুষকে) যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেই অনুযায়ীই তাকে কিয়ামতের দিন বিচার করা হবে।

তবে এখানে কেউ প্রশ্ন করতে পারে – ধরে নিলাম যে, পুরুষের এখানে নিজের কর্তৃত্বের জন্য গর্ব করার কোনো সুযোগ নেই; কিন্তু পুরুষ যখন কর্তৃত্বশীল, তখন এটা কি যৌক্তিক নয় যে, পুরুষ নারী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর?

এখানে আমরা পূর্বেই দেখিয়েছি যে, নারী ও পুরুষ আল্লাহর নিকট সমতুল্য। সুতরাং যখন সমতুল্যতার পয়েন্টকে আপনি প্রথমেই বিবেচনায় রাখবেন, তখন এটাও আপনি বুঝতে পারবেন যে, পুরুষের এই কর্তৃত্বের মর্যাদা আলোচিত হচ্ছে কেবল একটি প্রসঙ্গ বা context এর সাপেক্ষে; সামগ্রিক বিচারে নয়।
এখানে প্রসঙ্গ বা context হচ্ছে পুরুষের কিছু অতিরিক্ত কর্তব্য; আর সেই কর্তব্য হল এই যে, পুরুষকে নারীর অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে; নারীর দেখা-শোনা, নিরাপত্তা, ভরণপোষণের প্রয়োজন পূরণ করতে হচ্ছে। আর এই দায়িত্বগুলো নারীকে দেওয়া হচ্ছে না। কারণ এটাই নারীর প্রকৃতির সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ। কেন? সহজ একটি উদাহরণের সাহায্যে বুঝুন। আপনার বাড়িতে দুই জন ডাকাত এসে আক্রমণ করল। এখন বাড়িতে আপনি আর আপনার আরও দুই ভাই উপস্থিত। এবার আপনারা ভাইয়েরা বাড়ির মেয়ে আর মহিলাদের বললেন, ‘আমরা সমান অধিকারে বিশ্বাস করি বিধায় নারীকে সমান মর্যাদা দেওয়ার জন্য বাড়ির মেয়েদেরকে ডাকাতদের মোকাবেলা করতে বলব। আর আমরা শুধু খাটে বসে বসে তাদের চিয়ার আপ করে উৎসাহ যোগাব!’

বলুন তো, এটা কি অধিক ন্যায়সঙ্গত?
নাকি এই সিদ্ধান্ত নেওয়া অধিক যুক্তিযুক্ত যে, বাড়ির পুরুষেরা মিলে ডাকাতদের মোকাবেলা করবে?

বরং পুরুষেরা মিলে ডাকাতদের মোকাবেলা করাই অধিক প্রকৃতিসঙ্গত এবং ন্যায়সম্মতও। কেননা পুরুষকে আল্লাহ অধিক শক্তি-সামর্থ্য দান করেছেন। একারণে এটা পুরুষের দায়িত্ব যে, তাকে আল্লাহ যে সামর্থ্য অনুযায়ী দায়িত্ব দিয়েছেন, সেই দায়িত্ব সে যথাযথভাবে পালন করার চেষ্টা করবে। এখানে নারীর জন্য এটা বাধ্যতামূলক নয় যে, সে ডাকাতদের মোকাবেলা করবে। এখানে ইচ্ছা করলে সেও ডাকাতদের মোকাবেলা করতে পারে। কিন্তু এই দায়িত্ব তার জন্য বাধ্যতামূলক নয়। তাই বাড়ির শক্তিমান পুরুষ উপস্থিত থাকার পরও পুরুষকে ডাকাতের মোকাবেলা করতে না দিয়ে যদি নারী নিজে মোকাবেলা করতে যায়, তবে এক্ষেত্রে নারী ডাকাত দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর দায়ভার নারীর নিজের ওপর বর্তাবে, যেহেতু সে তার সামর্থ্যসম্পন্ন স্বামী ও ভাইদেরকে ডাকাতের মোকাবেলা করতে বাধা দিয়েছে।

একইভাবে, ইসলামে নারীর জন্যও এটা বাধ্যতামূলক নয় যে, সে বাইরে গিয়ে অর্থ উপার্জন করে পরিবারের খরচ যোগাবে। এটা পুরুষের জন্য বাধ্যতামূলক। বিয়ের পূর্বে এই দায়িত্ব মেয়ের বাবা, ভাইয়ের; বিয়ের পর স্বামীর। নারী যদি অর্থ উপার্জন না করে, এতে করে সে দোষণীয় হবে না। কারণ এটাই তার প্রকৃতির সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ, যেহেতু তাকে ক্রমাগত মাসিক ঋতুচক্রের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্ব পালন করতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন এই দায়িত্বগুলো পালন করার পরও নারী যদি বাইরে গিয়ে কাজ করে এবং ইসলামিক শরীয়তের সীমা অতিক্রম না করে, তবে এই অতিরিক্ত কাজ নারীর জন্য ঐচ্ছিক, বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে যদি নারী ইসলামিক শরীয়তের সীমা লঙ্ঘন করে, তবে এর জন্য তখন নারীকে দায়ী করা হবে।

আর যেহেতু নারীর জন্য এটা অধিক প্রকৃতিসঙ্গত যে, সে গৃহের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবে, সেহেতু পুরুষকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে গৃহকর্ত্রী হিসেবে তার (নারীর) চাহিদা, প্রয়োজনগুলো সঠিকভাবে পূরণ করার জন্য, নারীকে সঠিকভাবে গাইডলাইন দিয়ে নিরাপদভাবে পরিবার ও সমাজে দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। এক্ষেত্রে তাই এই দায়িত্ব পালনের context এ যেহেতু পুরুষ প্রকৃতিসঙ্গতভাবে কিছু অতিরিক্ত বাধ্যতামূলক কর্তব্য পালন করছে (নারীর অভিভাবক ও ভরণপোষণের দায়িত্ব), একারণে উক্ত context এর সাপেক্ষে পুরুষ এখানে কিছু অতিরিক্ত মর্যাদা লাভ করছে।

কিন্তু এই জাতীয় বিশেষ কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের অতিরিক্ত মর্যাদা লাভের অর্থ এটা নয় যে, সামগ্রিক বিচারে পুরুষ, নারী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর।

বিষয়টি বোঝার জন্য আরেকটি উদাহরণ দেখা যাক।

ধরুন, দুইজন শিক্ষকের মধ্যে একজন পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক, আর একজন ইংরেজির শিক্ষক। দুইজনের পদই কলেজে সমান। তারা সমান বেতন পান আর সমান পদমর্যাদাও পান। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসরকে হয়ত একটু বেশি খাটতে হচ্ছে। তার পদার্থবিজ্ঞানের প্রাকটিকাল ক্লাস আর টিউশন ক্লাস এর চাপ যত বেশি, ততখানি চাপের অর্ধেকেরও কম চাপ আর দায়িত্ব হয়ত ইংরেজির প্রফেসরকে পালন করতে হচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের পদমর্যাদা কলেজে সমান।

এক্ষেত্রে যদি কারও দায়িত্ব বেশি হয়, তবে সেই অধিক দায়িত্বের কারণে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক সেই পর্যায়ের কাজের জন্য সম্মান পাচ্ছেন। যেমন পদার্থবিজ্ঞানের স্যার হয়ত তার স্টুডেন্টদের প্রাকটিকাল ক্লাস করানোর সময় যে সম্মান পাচ্ছেন, সেটা ইংরেজির স্যার পাবেন না। কারণ ইংরেজির স্যারকে প্রাকটিকাল করাতে হচ্ছে না। কিন্তু তবুও দুইজন স্যারের পদমর্যাদা কম হচ্ছে না। কারণ তাদের কর্মক্ষেত্র আলাদা, কিন্তু সামগ্রিক বিচারে কলেজে পদমর্যাদা আসলে সমান।

একইভাবে নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে পুরুষের দায়িত্ব হয়ত কিছুটা বেশি। যেমন তাকে সর্বদা সালাত বা নামাজ আদায় করতে হচ্ছে, যেটা নারীকে হায়েয বা ঋতুস্রাব চলাকালীন সময়ে আদায় করতে হচ্ছে না। পুরুষকে রমজানে রোজা রাখতে হবে যেটা নারীকে গর্ভবতী অবস্থায় (কষ্টসাধ্য হলে পালন করতে) হচ্ছে না। পুরুষের ক্ষেত্রে সংসারের জন্য উপার্জন বাধ্যতামূলক, যেটা নারীর জন্য বাধ্যতামূলক নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই এই ক্ষেত্রগুলোতে পুরুষ কিছু অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছে বিধায় প্রকৃতিগতভাবে সে কিছু অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে। আর একারণে সেই অতিরিক্ত দায়িত্বের জন্য সেই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কিছু অতিরিক্ত মর্যাদাও সে পাচ্ছে। কিন্তু সেটি পুরুষ তার নিজস্ব অবস্থানে প্রাপ্ত হচ্ছে, যেটি নারীর অবস্থানের চেয়ে ভিন্নতর। আর তাই সামগ্রিক বিচারে নারীর সাথে তার এই অতিরিক্ত মর্যাদা তুলনীয় নয়, যেমনভাবে পদার্থবিজ্ঞানের প্রাকটিকাল ক্লাসে স্যারের প্রাপ্ত অতিরিক্ত মর্যাদার সাথে ইংরেজি প্রফেসর এর মর্যাদা সামগ্রিক বিচারে তুলনীয় নয়। এক্ষেত্রে নারী ও পুরুষকে তাদের নিজ নিজ অবস্থানের দায়িত্ব ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে নিজ নিজ অবস্থানে বিচার করা হবে এবং সমগ্র বিচারের মানদণ্ড হবে "তাকওয়া" (অর্থাৎ আল্লাহভীরুতা, ন্যায়পরায়ণতা, ধার্মিকতা ইত্যাদি)।

মহান আল্লাহ বলেন,

يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَٰكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَىٰ وَجَعَلْنَٰكُمْ شُعُوبًا وَقَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوٓا۟ۚ إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ ٱللَّهِ أَتْقَىٰكُمْۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ 

"হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদা সম্পন্ন যে অধিক তাকওয়া এর অধিকারী। আল্লাহ সব কিছু জানেন, সব কিছুর খবর রাখেন।"
(মহাগ্রন্থ আল-কুরআন, সূরা হুজুরাত (অধ্যায় ৪৯), আয়াত ১৩)

এক্ষেত্রে তাই যখন পুরুষকে অভিভাবক পদে এবং নারীকে তার অধীনস্থ হিসাবে নিযুক্ত করা হচ্ছে, তখন এর তাৎপর্য হল, এখানে পুরুষ ও নারীর নিজ নিজ প্রকৃতিসঙ্গত অবস্থানকে পৃথক করার পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, যাতে করে পুরুষ ও নারী উভয়েই তাদের সামর্থ্য ও প্রকৃতি অনুযায়ী পরিবার ও সমাজে তাদের দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করতে পারে। আর উপরিউক্ত আয়াত অনুযায়ী (সূরা হুজুরাত (অধ্যায় ৪৯), আয়াত ১৩) আমরা জানতে পারলাম যে, দায়িত্ব-কর্তব্যের বিভিন্নতা সত্ত্বেও সামগ্রিক বিচারে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড হচ্ছে "তাকওয়া", অর্থাৎ আল্লাহভীরুতা, ধার্মিকতা, ন্যায়পরায়ণতা প্রভৃতি।

একারণে চূড়ান্ত বিচারে কেবল অতিরিক্ত কিছু দায়িত্ব পাওয়ার জন্য পুরুষ, নারী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হবে না। বরং শ্রেষ্ঠত্বের বিচার হবে তাকওয়ার দ্বারা।
উদাহরণস্বরূপ, যদি স্ত্রীর মাসিক ঋতুচক্র চলার সময় স্বামী ১০০ রাকাত নফল নামাজ পড়ে, অথচ অন্য কোনো মেয়ের সাথে সে অবৈধ প্রেমে লিপ্ত হয়; তবে ওই ব্যক্তির স্ত্রী এখানে কেবল নিজের চরিত্রকে সৎ রাখলেই সে স্বামীর চেয়ে উত্তম হয়ে যাবে। কেন? কারণ এখানে স্ত্রীর তাকওয়া স্বামীর চেয়ে বেশি। মাসিক চলাকালে স্ত্রীকে নামাজ পড়তে হচ্ছে না। অথচ স্বামী ১০০ রাকাত অতিরিক্ত নফল নামাজ পড়ার পরও সে হারাম সম্পর্কে থাকার কারণে স্ত্রীর চেয়ে তার তাকওয়া কমে যাচ্ছে। এখানে পুরুষ তার স্ত্রীর চেয়ে অধিক নেক আমল করা সত্ত্বেও তাকওয়ার বিচারে সে তার স্ত্রীর থেকে পিছিয়ে পড়েছে তথা নিম্নতর হয়ে গেছে!

আবার ধরুন, স্ত্রী তার সন্তানদের সঠিকভাবে লালন-পালন করে, স্বামী-সন্তানদের সঠিকভাবে দেখা-শোনা করে এবং নামাজ, রোযা, পর্দা সবই সে ঠিকভাবে পালন করে। এখন রমজান মাস আসায় স্বামীকে নামাজ, রোযা দুটোই করতে হচ্ছে। অথচ এই সময়ে স্ত্রীর মাসিক ঋতুচক্র শুরু হয়ে গেল। ফলে শরীয়তের নিয়ম অনুযায়ী স্ত্রীকে আর নামাজ পড়তে হচ্ছে না।

এক্ষেত্রে এই সময়ে যদি স্বামী নামাজ না পড়ে, তবে স্বামী গোনাহগার তথা পাপী হবে। অথচ স্ত্রী যদি নামাজ না পড়ে, তবে সে গোনাহগার তথা পাপী হবে না (যদি স্ত্রী তার অন্যান্য দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করে)। কারণ স্ত্রীর হায়েজকালীন সময়ে নামাজ পড়ার সুযোগ নেই। বরং স্বামী স্ত্রীর চেয়ে বেশি নামাজ পড়লেও এক্ষেত্রে সামগ্রিক বিচারে সে তার স্ত্রীর চেয়ে শ্রেষ্ঠতর হতে পারবে না; কেননা এখানে মূল বিচার হচ্ছে তাকওয়া দিয়ে; পুরুষ আর নারী কে কত রাকাত নামাজ পড়ে প্রতিযোগিতা দিচ্ছে তার ওপর নয়। পুরুষ যদি রমজান মাসে মোট ৫০০ রাকাত নামাজ পড়ে পুরোটাই লোককে দেখানোর জন্য, আর স্ত্রী যদি হায়েজ চলাকালীন সময়ে এক রাকাত নামাজও পড়তে না পারে, তবুও এক্ষেত্রে স্ত্রীর মর্যাদা স্বামীর চেয়ে বেড়ে যাবে (যদি স্বামীর মত সে লোক দেখানো ইবাদত না করে আর নিজের চরিত্রকে সৎ রেখে তার অন্যান্য দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করে)। কেননা এখানে মূল বিচার সম্পন্ন হচ্ছে তাকওয়ার দ্বারা। পুরুষের অতিরিক্ত দায়িত্ব ও মর্যাদা থাকা সত্ত্বেও তার তাকওয়ার পরিমাণ একজন মুমিন নারীর তুলনায় যদি কমে যায়, তবে পুরুষ, সেই মুমিন নারীর চেয়ে নিম্নতর হয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে মুমিন নারী পুরুষের তুলনায় কিছু কম বৈশিষ্ট্য থাকার পরও সামগ্রিক বিচারে সে পুরুষ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট হতে পারে যদি সে তাকওয়ার মানদণ্ডে পুরুষের চেয়ে এগিয়ে যায়। একইভাবে তাকওয়ার মানদণ্ডে যদি পুরুষ এগিয়ে থাকে, তবে সামগ্রিক বিচারে পুরুষও নারী অপেক্ষা উৎকৃষ্ট হতে পারে।

তবে এখানে আরও একটি প্রশ্ন আসতে পারে যে, যদি নারী তাকওয়ার বিচারে উৎকৃষ্টই হয়, তাহলে কেন তাকে স্বামীর দাসত্ব করতে বলা হচ্ছে? স্বামীর দাসী হয়ে থাকাটাকে কি উৎকৃষ্টতা বলা যায়?

এই ধরণের চিন্তাধারা প্রকৃতপক্ষে মুশরিক তথা পৌত্তলিকদের দৃষ্টিভঙ্গি।

ইসলামের কালেমা হল, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”, যেখানে দুটি বিষয় রয়েছেঃ
১) “লা ইলাহা”, যেখানে অস্বীকৃতি রয়েছে;
২) “ইল্লাল্লাহ”, যেখানে স্বীকৃতি রয়েছে।

‘লা ইলাহা’ এর মাধ্যমে যত উপাস্য আছে তার সব কটিকে অস্বীকার করা হয়; আর ‘ইল্লাল্লাহ’ এর মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহকে সত্য উপাস্য তথা মাবুদ হিসেবে স্বীকার করা হয়।

এর সোজাসাপ্টা অর্থ হল এই যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত তথা দাসত্ব করা ইসলামে হারাম অর্থাৎ নিষিদ্ধ। আর তাই যেহেতু অন্য সকল উপাস্যকে ত্যাগ করে কেবল এক আল্লাহর ইবাদত বা উপাসনার নামই হল ইসলাম, সেহেতু যদি কেউ আল্লাহর সাথে সাথে অন্য কারও দাসত্ব করে, তবে সে আর মুসলিম থাকবে না। একারণে যদি বলা হয়, স্ত্রীকে স্বামীর দাসত্ব করতে হবে – তবে সেক্ষেত্রে এটাকে ইসলামিক ব্যবস্থা না বলে পৌত্তলিক ব্যবস্থা বলাই অধিক যুক্তিসঙ্গত।

এখানে এটা বোঝা উচিৎ যে, আনুগত্য অর্থ সব সময় দাসত্ব নয়; কোনো কোনো ক্ষেত্রে আনুগত্য এর তাৎপর্য দাসত্ব ব্যতীত সম্মান প্রদর্শনও হতে পারে। যেমন ধরুন, ইসলামের নির্দেশ হল, সন্তানকে তার পিতামাতার আনুগত্য করতে হবে। কিন্তু পিতামাতা যদি শির্ক করার নির্দেশ দেয়, তবে সন্তান সেই নির্দেশ পালন করবে না; যেহেতু মহান আল্লাহ বলেন, “আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে; তবে তারা যদি তোমার উপর বল প্রয়োগ করে, আমার সাথে এমন কিছু শরীক করতে যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তবে তুমি তাদেরকে মান্য করো না…” (আল-কুরআন, ২৯:৮)
এক্ষেত্রে পিতামাতার আনুগত্য এর তাৎপর্য হল তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, কিন্তু দাসত্ব কেবল আল্লাহর জন্যই নির্ধারিত।
একইভাবে স্ত্রীর ক্ষেত্রে স্বামীর আনুগত্য হল স্বামীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন, কিন্তু এক্ষেত্রেও দাসত্ব কেবল আল্লাহর জন্যই সুনির্দিষ্ট। একারণে স্বামী যদি হারাম কাজ করতে স্ত্রীকে নির্দেশ করে, তবে আল্লাহর দাসী হওয়ার দরুণ স্ত্রী স্বামীর আনুগত্য করবে না।

এখানে অনেকে পাল্টা প্রশ্ন করতে পারে – যদি আনুগত্য অর্থ সম্মান প্রদর্শনই হয়, তবে স্বামীকে কেন নির্দেশ দেওয়া হল না যে, সেও স্ত্রীর আনুগত্য করবে?

এর উত্তর হল, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সম্মান প্রদর্শনের ধরণও পাল্টে যায়। যেমন ধরুন, আপনি আপনার ছোট ভাইকে যেভাবে সম্মান করবেন, আপনার বন্ধুর বাবাকে সেভাবে সম্মান করবেন না। আপনার শিক্ষককে যেভাবে সম্মান করবেন, আপনার বন্ধুকে সেভাবে সম্মান করবেন না। আপনার বড় বোনকে যেভাবে সম্মান করবেন, আপনার মাকে সেভাবে সম্মান করবেন না। একেক জনের জন্য সম্মান প্রদর্শনের প্রকাশভঙ্গি একেক রকম। আপনি আপনার বন্ধুর পিঠে ঠাট্টা করে আস্তে একখানা চড় দিলেও আপনার বন্ধু হয়ত তেমন কিছু মনে করবে না। কিন্তু একই কাজ আপনি আপনার শিক্ষক, পিতা অথবা বন্ধুর পিতার সাথে করলে সেখানে আপনার কোনো মান-সম্মান থাকবে না।

একইভাবে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক অনুযায়ী তাদের একে অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রকাশভঙ্গি উভয়ের ক্ষেত্রে ভিন্নতর হওয়াও অস্বাভবিক কোনো ব্যাপার নয়। যেহেতু, ইসলামিক মানদণ্ডে মহান আল্লাহ পুরুষকে পরিবারের নেতার দায়িত্ব দিয়েছেন, তাই পরিবারের সদস্য হিসেবে স্ত্রীর দায়িত্ব সেই নেতার মতামতকে সম্মান দেওয়া, তাকে গুরুত্ব দেওয়া। তবে নেতার যদি কোনো ভুল হয়, স্ত্রী হিসেবে সে অবশ্যই সেখানে প্রতিবাদ করতে পারে। কিন্তু সেই প্রতিবাদের প্রকাশভঙ্গি হবে মার্জিত আকারে পরামর্শ প্রদানের মত; পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়ার মত নয়!

এখানে একটি মনস্তত্ত্ব কাজ করে।

সেটি হল এই যে, পুরুষ প্রকৃতিগতভাবে অধিক উগ্র হয়ে থাকে এবং নারী হয়ে থাকে কোমল। এটা বাহ্যিক প্রকাশ। কিন্তু অভ্যন্তরে পুরুষ নারীর প্রতি অত্যন্ত দুর্বল! ফলশ্রুতিতে দেখা যায় যে, নারী যদি সদ্ভাব বজায় রেখে মিষ্টি হাসিতে পুরুষকে কিছু বলে, তবে পুরুষ সহজেই নারীর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে ও নারীর কথাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে শুরু করে। অন্যদিকে নারী যদি পুরুষের সাথে রূঢ় আচরণ করে, তবে পুরুষও নারীর প্রতি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে।

কিন্তু উল্টোটা কিছুটা ব্যতিক্রম।

পুরুষ যদি নারীর সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে মিষ্টি ভাষায় কথাও বলে, তবুও নারী নিজের সিদ্ধান্তেই বেশিরভাগ সময় অটল থাকে এবং পুরুষের ভিন্ন মতের সে গুরুত্ব দেয় না। এক্ষেত্রে তাই স্বাভাবিকভাবে একজন স্বামী যতই ভাল ব্যবহার করুক না কেন, স্ত্রী সহজে তার নিজের মতামত পাল্টাতে চায় না। তার নাফস তাকে বলতে থাকে স্বামীর কথার বিরুদ্ধাচারণ করতে। শয়তান ও নাফসের মিলিত প্ররোচনায় সে ভাবতে থাকে, ‘আমি আমার মত চলব। আমার স্বামীর মতের আবার কী প্রয়োজন? আমি কি কম বুঝি, নাকি আমি আমার স্বামীর দাসী!’ এহেন মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার কারণে স্বাভাবিকভাবেই নারীর মধ্যে এই প্রবণতা কাজ করে যে, সে তার স্বামীর মতামতকে কোনো গুরুত্বই দেবে না। আর তাই নাফসের এই জটিলতাকে দূর করার জন্য নারীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, স্বামীর মতকে গুরুত্ব দিতে এবং সেই মত তার নিজের মতের বিপরীতে গেলেও তার বিরুদ্ধাধারণ না করতে। আর এর জন্য প্রয়োজন স্বামীর আনুগত্য। যদি স্ত্রী, স্বামীর আনুগত্য করে নিজের নাফসের কুপরামর্শকে জয় করতে পারে, তবে সংসারে যেমন শান্তি বিরাজ করে, তেমনি স্বামী যদি ভুল কোনো পরামর্শ দেয়, তবে স্ত্রী ধৈর্যধারণ করে পরবর্তীতে স্বামীর সাথে তার উত্তম মেজাজের সময় আলোচনা করার মাধ্যমে তাকে সঠিক বিষয়টি বোঝাতেও সক্ষম হয়। পুরুষ যেহেতু এখানে উগ্র আর নারী কোমলতর, তাই উভয়কেই তাদের নিজ নিজ প্রকৃতি অনুসারে দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রদান করা হয়েছে। পুরুষকে তার প্রকৃতি অনুযায়ী পরিবারের নেতা এবং নারীকে তার প্রকৃতি অনুযায়ী স্বামীর আনুগত্যকারিণী ও গৃহকর্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।


এখানে উক্ত এই হাদিস থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, স্বামী যেমন তার পরিবারের রক্ষক, তেমনি স্ত্রী তার স্বামীর গৃহের রক্ষক। একারণে আল্লাহ বলেন,

هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ
"তারা (স্ত্রীরা) তোমাদের (স্বামীদের) জন্য আবরণ এবং তোমরা (স্বামীরা) তাদের (স্ত্রীদের) জন্য আবরণ।’’ [মহাগ্রন্থ আল-কোরআন, ২:১৮৭]

অর্থাৎ এখানে সম্পর্ক mutual understanding বা পারস্পরিক সমঝোতার মত, প্রতিদ্বন্দ্বিতার মত নয়।
.
.
.
উপরের এই আলোচনা হতে তাই আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, ইসলামে নারী ও পুরুষের অবস্থানকে সঠিকভাবে বুঝতে আমাদের উচিৎ নারী ও পুরুষকে স্বতন্ত্রভাবে বিবেচনা করা। নারী ও পুরুষ একে অপরের থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। তাই তাদের অধিকার, দায়িত্ব-কর্তব্যও যে তাদের নিজ নিজ প্রকৃতির সাথে সামাঞ্জস্য রেখে ভিন্নতর হবে, এটাই যুক্তিযুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত। একারণে ইসলামিক বিচারে নারী ও পুরুষের ভিন্নতা নারীর পুরুষ অপেক্ষা নিম্নতর অবস্থানকে নয়, বরং নারী ও পুরুষের পরিপূরকতা ও সমতুল্যতাকেই তুলে ধরে।

আল্লাহই ভাল জানেন।
.
.
.
আরও পড়ুনঃ



Post a Comment

0 Comments