তাকদীর বনাম স্বাধীনতা (সংক্ষিপ্ত আলোচনা)


লেখক:- শায়েখ সালেহ আল উসাইমীন
(বাংলা অনুবাদকৃত) 
__________________________________________________________________________________

উত্তর: 

আলহামদু লিল্লাহ।.

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। তাকদীর বা ভাগ্য: এ মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটবে আল্লাহ তাআলা কর্তৃক তাঁর পূর্বজ্ঞান ও প্রজ্ঞা অনুযায়ী সেসব কিছু নির্ধারণ করে রাখাকে তাকদীর বলা হয়। তাকদীরের প্রতি ঈমান চারটি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। এক:
এই ঈমান আনা যে, আল্লাহ তাআলা প্রত্যেকটি বিষয় সম্পর্কে সমষ্টিগতভাবে ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানেন। তাঁর এ জানা অনাদি ও অনন্ত -তাঁর নিজ কর্ম সম্পর্কে অথবা বান্দার কর্ম সম্পর্কে।

দুই:

এই ঈমান আনা যে, আল্লাহ তাআলা লওহে মাহফুজে সবকিছু লিখে রেখেছেন।

এ দুটি বিষয় সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন: “তুমি কি জান না যে,নভোমণ্ডলে ও ভুমন্ডলে যা কিছু আছে আল্লাহ সবকিছু জানেন। নিশ্চয় এসব কিতাবে লিখিত আছে। নিশ্চয় এটা আল্লাহর কাছে সহজ।”[সূরা হজ্জ, আয়াত: ৭০] সহিহ মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে- তিনি বলেন, “আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি বলেন: আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিকূল সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগে সৃষ্টিকূলের তাকদীর লিখে রেখেছেন।”

তিনি আরো বলেন: “আল্লাহ তাআলা প্রথম সৃষ্টি করেছেন কলম। সৃষ্টির পর কলমকে বললেন: ‘লিখ’। কলম বলল: ইয়া রব্ব! কী লিখব? তিনি বললেন: কেয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক জিনিসের তাকদীর লিখ।”[ আবু দাউদ (৪৭০০)] আলবানি সহিহ আবু দাউদ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।

তিন:

এই ঈমান রাখা যে, কোন কিছুই আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে ঘটে না। হোক না সেটা আল্লাহর কর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট অথবামাখলুকের কর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট। আল্লাহ তাআলা বলেন: “আপনার পালনকর্তা যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং (যা ইচ্ছা) মনোনীত করেন।”[সূরা কাসাস, আয়াত: ৬৮] তিনি আরো বলেন: “এবং আল্লাহ যা ইচ্ছা সেটাই করেন”[সূরা ইব্রাহিম, আয়াত: ২৭] তিনি আরো বলেন: “তিনিই মাতৃগর্ভে তোমাদেরকে আকৃতি দান করেন যেভাবে ইচ্ছা করেন সেভাবে।”[সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৬]

বান্দার কর্ম সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন: “আর আল্লাহ ইচ্ছা করলে অবশ্যই তাদেরকে তোমাদের উপর ক্ষমতা দিতে পারতেন। যাতে তারা নিশ্চিতরূপে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারত।”[সূরা নিসা, আয়াত: ৯০] তিনি আরো বলেন: “তোমার রব যদি ইচ্ছা করত, তবে তারা তা করত না”[সূরা আল-আনআম, আয়াত: ১১২] অতএব, সকল ঘটনা, সকল কর্ম, সকল অস্তিত্ব আল্লাহর ইচ্ছাই হয়। আল্লাহ যা চান সেটাই হয়, তিনি যা চান না, সেটা হয় না। চার:

যাবতীয় সবকিছুর জাত, বৈশিষ্ট্য, গতি ও স্থিতি সব আল্লাহর-ই সৃষ্টি।

আল্লাহ তাআলা বলেন: “আল্লাহ সবকিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সবকিছুর তত্ত্বাবধায়ক।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৬২] তিনি আরো বলেন: “তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেককে যথোচিত আকৃতি দান করেছেন।” [সূরা ফুরকান, আয়াত:২] তিনি নবী ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেন তিনি তাঁর কওমকে উদ্দেশ্য করে বলেন: “অথচ আল্লাহই তোমাদেরকে এবং তোমরা যা কর তা সৃষ্টি করেছেন?”[সূরা আস্‌-সাফ্‌ফাত, আয়াত:৯৬]

যে ব্যক্তি এ বিষয়গুলোর প্রতি ঈমান এনেছে সে তাকদীরের প্রতি সঠিকভাবে ঈমান এনেছে। এতক্ষণ আমরা তাকদিরের প্রতি ঈমান আনার যে বিবরণ দিলাম সেটা কর্মের ক্ষেত্রে বান্দার ইচ্ছাশক্তি থাকা ও ক্ষমতা থাকার সাথে সাংঘর্ষিক নয়। বান্দার ইচ্ছাশক্তি রয়েছে। বান্দা ইচ্ছা করলে কোন নেক কাজ করতে পারে এবং ইচ্ছা করলে তা বর্জন করতে পারে। ইচ্ছা করলে কোন গুনাহর কাজ করতে পারে এবং ইচ্ছা করলে তা বর্জন করতে পারে। শরিয়তের দলিল ও বাস্তব দলিল বান্দার এ ইচ্ছাশক্তি সাব্যস্ত করে।

শরয়ি দলিল হচ্ছে- আল্লাহ তাআলা বলেন: “ঐ দিনটি সত্য। অতএব যার ইচ্ছা সে তার রবের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করুক।”[সূরা নাবা, আয়াত: ৩৯]

তিনি আরো বলেন: “সুতরাং তোমরা তোমাদের ফসলক্ষেতে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে গমন কর”[সূরা বাকারা, আয়াত: ২২৩] তিনি বান্দার সক্ষমতা সম্পর্কে বলেন: “অতএব, তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় কর”[সূরা তাগাবুন, আয়াত: ১৬] তিনি আরো বলেন: “আল্লাহ কোন ব্যক্তিকে তার সামর্থ্যের বাইরে দায়িত্ব দেন না। সে যা অর্জন করে তা তার-ই জন্য এবং সে যা কামাই করে তা তার-ই উপর বর্তাবে।”[সূরা বাকারা, আয়াত: ২৮৬]

এ আয়াতগুলো সাব্যস্ত করে যে, মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও ক্ষমতা রয়েছে। এ দুটির মাধ্যমে সে যা ইচ্ছা তা করতে পারে এবং যা ইচ্ছা তা বর্জন করতে পারে।

বাস্তব দলিল: প্রত্যেক মানুষ জানে যে, তার ইচ্ছাশক্তি ও ক্ষমতা রয়েছে। এ দুটোর মাধ্যমে সে যা ইচ্ছা তা করতে পারে এবং যা ইচ্ছা তা বর্জন করতে পারে। মানুষ তার ইচ্ছায় সাধিত কর্ম যেমন- হাঁটা এবং তার অনিচ্ছায় সাধিত কর্ম যেমন- রোগীর কাঁপুনি এতদুভয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। তবে মানুষের ইচ্ছা ও ক্ষমতা আল্লাহর ইচ্ছা ও ক্ষমতার অনুবর্তী। এর দলিল হচ্ছে আল্লাহ তাআলার বাণী: “যে তোমাদের মধ্যে সরল পথে চলতে চায়- তার জন্য। আর তোমরা ইচ্ছা করতে পার না, যদি না সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ ইচ্ছা করেন।” [সূরা তাকবীর, আয়াত: ২৮-২৯]

তাছাড়া গোটা মহাবিশ্ব আল্লাহ তাআলার মালিকানাধীন। অতএব, তাঁর মালিকানাভুক্ত রাজ্যে কোন কিছু তাঁর অজ্ঞাতসারে অথবা অনিচ্ছায় ঘটা সম্ভব নয়।

আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।

দেখুন: ‘শরহু উসুলুল ঈমান"

তাকদীরের মাসআলা নিয়ে বহু দিন যাবৎ মানুষের মাঝে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। এ জন্যই মানুষ তাকদীরের মাসআলাকে কেন্দ্র করে তিনভাগে বিভক্ত হয়েছে।

১. এক শ্রেণির লোক বলে থাকে সব কিছু পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্য অনুযায়ী সংঘটিত হয়। এতে মানুষের ব্যক্তিগত কোনো স্বাধীনতা নেই। এদের মতে প্রচণ্ড বাতাসের কারণে ছাদে থেকে কোনো মানুষ নিচে পড়ে যাওয়া এবং স্বেচ্ছায় সিড়ি বেয়ে নেমে আসা একই রকম।

২. অন্য একদলের মতে মানুষ তার কর্মে সম্পূর্ণ স্বাধীন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কর্তৃক লিখিত ভাগ্যকে তারা সরাসরি অস্বীকার করে। তাদের মতে মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন রূপে কর্ম সম্পাদন করে থাকে। ভাগ্য বলতে কিছু নেই।

৩. উভয় দলের মাঝখানে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা হলো, তাঁরা আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারিত তাকদীরে বিশ্বাস করেন। সাথে সাথে তারা কর্ম নির্বাচনের ক্ষেত্রে বান্দার স্বাধীনতাকে স্বীকার করেন। বান্দার কর্ম আল্লাহর নির্ধারণ এবং বান্দার নির্বাচনের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়ে থাকে। ছাদে থেকে বাতাসের চাপে মাটিতে পড়ে যাওয়া এবং স্বেচ্ছায় সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার মাঝে মানুষ অবশ্যই পার্থক্য করতে জানে। প্রথমটিতে তার কোনো ইচ্ছা ছিলনা এবং দ্বিতীয়টি তার ইচ্ছা অনুযায়ী সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু উভয় কাজ আল্লাহর ফায়সালা অনুযায়ীই সংঘটিত হয়েছে। আল্লাহর রাজত্বে তাঁর ইচ্ছার বাইরে কিছুই সংঘটিত হয় না, তা সম্পর্কেই তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে। শরী‘আতের আদেশ-নিষেধ অমান্য করে তাকদীরের মাধ্যমে দলীল পেশ করার কোনো সুযোগ নেই। কেননা শরী‘আত বিরোধী কর্মের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় সে আল্লাহর নির্ধারণ সম্পর্কে অবগত থাকে না। স্বেচ্ছায় পাপ কাজের প্রতি অগ্রসর হওয়ার কারণেই দুনিয়া বা আখেরাতে শাস্তির সম্মুখীন হবে। কাউকে পাপ কাজে বাধ্য করা হলে তাকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। যেমন, একজন অন্য জনকে জোরপুর্বক মদ পান করিয়ে দিলে মদপানকারীকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। কারণ, এক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় সে পান করে নি। মানুষ ভালো করেই জানে যে, আগুন থেকে পালিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করা এবং বসবাসের জন্য সুন্দর ঘরবাড়ি নির্বাচন করা তার আপন পছন্দ অনুযায়ী হয়ে থাকে। সুন্দর ঘরবাড়ি নির্ধারণ এবং আগুন থেকে বাঁচার সুযোগ থাকা সত্বেও যে মানুষ সে সুযোগ গ্রহণ করে নি, তাকে সুযোগ নষ্ট করার জন্য তিরস্কার করা হয়। তবে কী জন্যে সে পরকালের আযাব থেকে রেহাই পাওয়ার এবং জান্নাত আবশ্যককারী আমলগুলো ছেড়ে দেওয়াকে নিজের অপরাধ মনে করবে না?

বর্ণিত প্রশ্নে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ যদি কারও তাকদীরে লিখে রাখেন যে, সে একটি মসজিদ বানাবে, সে অবশ্যই মসজিদটি বানাবে, কিন্তু কীভাবে বানাবে সে ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন এ উদাহরণটি ঠিক নয়। কেননা তাতে ধারণা করা হয় যে, নির্মাণের পদ্ধতি সম্পূর্ণ বান্দার হাতে। এতে আল্লাহর কোনো হাত নেই। সঠিক কথা এই যে, নির্মাণ করা এবং নির্মাণের পদ্ধতি সবই তাকদীরে নির্ধারিত। উভয়টি নির্বাচনে বান্দার স্বাধীনতা রয়েছে। তবে তাকে বাধ্য করা হয় নি। যেমনভাবে তাকে আপন ঘরবাড়ি নির্মাণ বা মেরামত করতে বাধ্য করা হয় নি। তাকদীর সম্পূর্ণ গোপন বিষয়। অহীর মাধ্যমে যাকে আল্লাহ অবগত করান সেই কেবল জানতে পারে। এমনিভাবে নির্মাণের পদ্ধতিও আল্লাহর নির্ধারণের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। সমস্ত জিনিসের বিবরণ বিস্তারিতভাবে এবং সংক্ষিপ্তভাবে তাকদীরে লিখিত আছে।

আল্লাহ যে বিষয়ের ইচ্ছা করেন বা নির্ধারণ করেন, তা ব্যতীত বান্দার পক্ষে অন্য কিছু নির্বাচন করা সম্ভব নয়; বরং বান্দা যখন কোনো কিছু করে, তখন সে ভালো করেই জানে যে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সকল কর্ম সৃষ্টি ও নির্ধারণ করেন আর বান্দা প্রকাশ্যভাবে তা সম্পাদন করে। বান্দা যখন কর্ম সম্পাদন করে, তখন সে অনুভবই করতে পারে না যে, কেউ তাকে কাজটি করতে বাধ্য করছে। বাহ্যিক উপকরণের মাধ্যমে বান্দা যখন কাজটি করে ফেলে, তখন সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহই তার ভাগ্যে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।

প্রশ্নে বর্ণিত মানুষের পাপ কাজের যে উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, তাতে আমরা তাই বলব, যা আমরা মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে বলেছি। বান্দা কর্তৃক স্বেচ্ছায় কোনো কাজ নির্বাচন করা আল্লাহর নির্ধারণের পরিপন্থী নয়। কেননা কাজ করার জন্য বান্দা যখন অগ্রসর হয়, তখন সে সেচ্ছায় কাজটি নির্বাচন করেই অগ্রসর হয় এবং সে জানে না যে, কেউ তাকে কাজ করার জন্য বাধ্য করছে। কিন্তু যখন সে করে ফেলে, তখন সে জানতে পারে যে, আল্লাহ তার জন্যে কাজটি নির্ধারণ করেছেন। এমনিভাবে পাপকাজে লিপ্ত হওয়া এবং তার প্রতি অগ্রসর হওয়া বান্দার নির্বাচনের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। এটি তাকদীরের খেলাফ নয়। আল্লাহই সকল কিছুর একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। সকল কর্ম বাস্তবায়নের উপকরণও তিনি সৃষ্টি করেছেন। বান্দার পক্ষ থেকে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যে সকল কাজ সংঘটিত হয়, তা সবই আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত। আল্লাহ বলেন,

﴿أَلَمۡ تَعۡلَمۡ أَنَّ ٱللَّهَ يَعۡلَمُ مَا فِي ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِۚ إِنَّ ذَٰلِكَ فِي كِتَٰبٍۚ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرٞ﴾ [الحج: ٧٠]

“তুমি কি জান না যে, আল্লাহ জানেন যা আকাশে ও জমিনে আছে। এসব কিতাবে লিখিত আছে। এটা আল্লাহর কাছে সহজ।” [সূরা আল-হজ, আয়াত: ৭০]

আল্লাহ বলেন,

﴿وَكَذَٰلِكَ جَعَلۡنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوّٗا شَيَٰطِينَ ٱلۡإِنسِ وَٱلۡجِنِّ يُوحِي بَعۡضُهُمۡ إِلَىٰ بَعۡضٖ زُخۡرُفَ ٱلۡقَوۡلِ غُرُورٗاۚ وَلَوۡ شَآءَ رَبُّكَ مَا فَعَلُوهُۖ فَذَرۡهُمۡ وَمَا يَفۡتَرُونَ﴾ [الانعام: ١١٢]

“এমনিভাবে আমি প্রত্যেক নবীর জন্যে শত্রু হিসেবে সৃষ্টি করেছি মানুষ ও জিন্ন শয়তানদের। তারা ধোঁকা দেওয়ার জন্যে একে অপরকে চাকচিক্যপূর্ণ প্রবঞ্চনা মূলক কথা-বার্তা শিক্ষা দেয়। যদি আপনার রব চাইতেন, তবে তারা এ কাজ করত না।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১১২]

আল্লাহ আরো বলেন,

﴿وَكَذَٰلِكَ زَيَّنَ لِكَثِيرٖ مِّنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ قَتۡلَ أَوۡلَٰدِهِمۡ شُرَكَآؤُهُمۡ لِيُرۡدُوهُمۡ وَلِيَلۡبِسُواْ عَلَيۡهِمۡ دِينَهُمۡۖ وَلَوۡ شَآءَ ٱللَّهُ مَا فَعَلُوهُۖ فَذَرۡهُمۡ وَمَا يَفۡتَرُونَ﴾ [الانعام: ١٣٧]

“এমনিভাবে অনেক মুশরেকের দৃষ্টিতে তাদের উপাস্যরা সন্তান হত্যাকে সুশোভিত করে দিয়েছে। যেন তারা তাদেরকে বিনষ্ট করে দেয় এবং তাদের ধর্মমতকে তাদের কাছে বিভ্রান্ত করে দেয়। যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে তারা এ কাজ করত না। অতএব, আপনি তাদেরকে এবং তাদের মিথ্যাচারিতাকে পরিত্যাগ করুন।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৩৭]

আল্লাহ আরো বলেন,

﴿وَلَوۡ شَآءَ ٱللَّهُ مَا ٱقۡتَتَلَ ٱلَّذِينَ مِنۢ بَعۡدِهِم مِّنۢ بَعۡدِ مَا جَآءَتۡهُمُ ٱلۡبَيِّنَٰتُ وَلَٰكِنِ ٱخۡتَلَفُواْ فَمِنۡهُم مَّنۡ ءَامَنَ وَمِنۡهُم مَّن كَفَرَۚ وَلَوۡ شَآءَ ٱللَّهُ مَا ٱقۡتَتَلُواْ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ يَفۡعَلُ مَا يُرِيدُ﴾ [البقرة: ٢٥٣]

“আর আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন, তাহলে পরিস্কার নির্দেশ এসে যাবার পর পয়গাম্বরদের পেছনে যারা ছিল তারা লড়াই করত না; কিন্তু তাদের মধ্যে মতবিরোধ হয়ে গেছে। অতঃপর তাদের কেউ তো ঈমান এনেছে, আর কেউ হয়েছে কাফির। আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন, তাহলে তারা পরস্পরে লড়াই করতো না, কিন্তু আল্লাহ তাই করেন, যা তিনি ইচ্ছা করেন।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫২]

কোনো মানুষের উচিৎ নয় যে, নিজের ভিতরে বা অন্যের ভিতরে এমন কোনো জিনিসের অনুসন্ধান করা, যা অপরের জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে এবং তাকদীরের মাধ্যমে শরী‘আতের বিরোধীতা করার ধারণা সৃষ্টি হতে পারে। সাহাবীদের আমল এ রকম ছিলনা। ইবন আবু তালেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«مَا مِنْكُمْ مِنْ نَفْسٍ مَنْفُوسَةٍ إِلَّا كُتِبَ مَكَانُهَا مِنَ الْجَنَّةِ وَالنَّارِ وَإِلَّا قَدْ كُتِبَ شَقِيَّةً أَوْ سَعِيدَةً فَقَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَلَا نَتَّكِلُ عَلَى كِتَابِنَا وَنَدَعُ الْعَمَلَ فَمَنْ كَانَ مِنَّا مِنْ أَهْلِ السَّعَادَةِ فَسَيَصِيرُ إِلَى عَمَلِ أَهْلِ السَّعَادَةِ وَأَمَّا مَنْ كَانَ مِنَّا مِنْ أَهْلِ الشَّقَاوَةِ فَسَيَصِيرُ إِلَى عَمَلِ أَهْلِ الشَّقَاوَةِ قَالَ أَمَّا أَهْلُ السَّعَادَةِ فَيُيَسَّرُونَ لِعَمَلِ السَّعَادَةِ وَأَمَّا أَهْلُ الشَّقَاوَةِ فَيُيَسَّرُونَ لِعَمَلِ الشَّقَاوَةِ ثُمَّ قَرَأَ ﴿فَأَمَّا مَنۡ أَعۡطَىٰ وَٱتَّقَىٰ ٥ وَصَدَّقَ بِٱلۡحُسۡنَىٰ الْآيَةَ»

“তোমাদের মধ্যে এমন কোনো লোক নেই, যার ঠিকানা জান্নাতে অথবা জাহান্নামে লিখে দেওয়া হয় নি। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমরা কি ভাগ্যের লেখার ওপর ভরসা করে বসে থাকব না এবং আমল বর্জন করব না? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘না বরং তোমরা আমল কর। কারণ, প্রত্যেক ব্যক্তিকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, তার জন্য সে কাজ সহজ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি সৌভাগ্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবে, তার জন্য সৌভাগ্যশীলদের আমল সহজ করে দেওয়া হবে আর যে ব্যক্তি দুর্ভাগ্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবে, তার জন্য দুর্ভাগ্যশীলদের আমল সহজ করে দেওয়া হবে।’ অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের এ আয়াতটি পাঠ করলেন,

﴿
فَأَمَّا مَنۡ أَعۡطَىٰ وَٱتَّقَىٰ ٥ وَصَدَّقَ بِٱلۡحُسۡنَىٰ ٦ فَسَنُيَسِّرُهُۥ لِلۡيُسۡرَىٰ ٧ وَأَمَّا مَنۢ بَخِلَ وَٱسۡتَغۡنَىٰ ٨ وَكَذَّبَ بِٱلۡحُسۡنَىٰ ٩ فَسَنُيَسِّرُهُۥ لِلۡعُسۡرَىٰ﴾ [الليل: ٥، ١٠]

“অতএব, যে দান করে, আল্লাহ ভীরু হয় এবং উত্তম বিষয়কে সত্যায়ন করে। আমি তাকে সুখের বিষয়ের (জান্নাতের) জন্যে সহজ পথ দান করব। আর যে কৃপণতা করে ও বেপরওয়া হয় এবং উত্তম বিষয়কে মিথ্যা মনে করে। আমি তাকে কষ্টের বিষয়ের (জাহান্নামের) জন্যে সহজ পথ দান করব”। [সূরা আল-লাইল, আয়াত: ৫-১০]”[1]

উপরোক্ত হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাগ্যের লিখনের ওপর নির্ভর করে আমল ছেড়ে দিতে নিষেধ করেছেন। কারণ, সৌভাগ্যবান না দুর্ভাগ্যবান, তা জানার কোনো উপায় নেই এবং মানুষকে তার সাধ্যানুযায়ী আমল করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। কুরআনের আয়াত দিয়ে প্রমাণ করা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি ঈমান আনবে এবং সৎ আমল করবে, তার জন্য কল্যাণের সহজ পথকে আরো সহজ করে দিবেন। এটিই ফলদায়ক ঔষধ। এর মাধ্যমেই বান্দা তার সৌভাগ্যের উচ্চ শিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হবে এবং ঈমান আনার সাথে সাথে সৎ আমল করার জন্যে সদা স্বচেষ্ট থাকবে।

আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন সৎআমল করার তাওফীক দেন, ভালো পথ সহজ করে দেন, কঠিন পথ থেকে আমাদেরকে দূরে রাখেন এবং দুনিয়া-আখেরাতে ক্ষমা করেন।

[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: তাফসীরুল কুরআন; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: তক্বদীর।

[ বিঃদ্রঃ তাকদীর বিষয়ে বিস্তারিত জানতে লেখকের এই বইটি পড়া যেতে পারে। তাকদীর নিয়ে সংশয় দূর হবে ইনশাআল্লাহ। বইটি পড়ুন (ডাউনলোড ইবুক) ]

Post a Comment

0 Comments