ইসলাম কি স্ত্রী নির্যাতনের অনুমতি দেয়??


🖋Author:- Ahmed Al-Ubaydullaah
__________________________________________________________________________________
(ইসলামবিদ্বেষীদের অজ্ঞতার জবাব)
.
.
স্ত্রী নির্যাতন বলতে সাধারণত দুইভাবে স্ত্রীকে স্বামী নির্যাতন করতে পারে - ১) শারীরিকভাবে, ২) মানসিকভাবে।
ইসলামবিদ্বেষীরা তাদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ইসলামকে বিচার করতে এসে তাদের কুচিন্তা দিয়ে ইসলামিক বিষয়কে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে আর ইসলামে স্ত্রী নির্যাতনের বিষয়কেও প্রতিষ্ঠা করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে!
.
যদি স্ত্রী নির্যাতনের বিষয়তে লক্ষ্য করা হয়, তবে শারীরিক আর মানসিক নির্যাতন বহুভাবে হতে পারে। তবে এখানে প্রধান যে বিষয় দুটোর ওপর ফোকাস করা হয়, সেটা হল -
১) স্ত্রীর ওপর যৌন নির্যাতন,
২) স্ত্রীর ওপর শারীরিক প্রহার।
.
এখন স্ত্রীর ওপর যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে কোরআন এর এই আয়াতটি প্রায়ই উদ্ধৃত করা হয়।
.
نِسَآؤُكُمْ حَرْثٌ لَّكُمْ فَأْتُوا۟ حَرْثَكُمْ أَنَّىٰ شِئْتُمْۖ وَقَدِّمُوا۟ لِأَنفُسِكُمْۚ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَٱعْلَمُوٓا۟ أَنَّكُم مُّلَٰقُوهُۗ وَبَشِّرِ ٱلْمُؤْمِنِينَ
.
"তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের শস্যক্ষেত্র। অতএব তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছে গমন করতে পার। আর তোমরা নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য কিছু করো এবং আল্লাহ্‌কে ভয় করো। এবং জেনে রেখো, তোমরা অবশ্যই আল্লাহ্‌র সম্মুখীন হবে। আর মুমিনদেরকে সুসংবাদ দিন।"[১]
.
এই আয়াতে //তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের শস্যক্ষেত্র। অতএব তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছে গমন করতে পার// এই অংশ নিয়েই যত আপত্তি!
.
এই আয়াত সম্পর্কে বলার আগে বলি, যদি "স্ত্রী" বাদ দিয়ে এখানে "গার্ল ফ্রেন্ড" বলা হত, তাহলে ইসলামবিদ্বেষীদের কোনো সমস্যা থাকত না! কারণ সেক্ষেত্রে গার্লফ্রেন্ডের সাথে যেভাবে খুশি যৌনাচার করার লাইসেন্স তারা পেয়ে যেত! কিন্তু যত সমস্যা এই যে স্ত্রীকে শস্যক্ষেত্র বলা হয়েছে, এখানেই।
.
প্রথমেই বলি, এখানে "স্ত্রী" শব্দ ব্যবহারের অর্থ কী? ইসলামে "স্ত্রী" বললে তার মর্যাদা বেড়ে যাচ্ছে, কেননা একজন দীনদার স্ত্রী এর মর্যাদা একজন পতিতা নারী বা ব্যভিচারী নারীর থেকে অনেক উর্ধ্বে।
.
"‘আবদুল্লাহ্ ইবনু ‘আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ গোটা দুনিয়াই হলো সম্পদ। আর দুনিয়ার মধ্যে পুণ্যবতী স্ত্রীলোকের চেয়ে অধিক উত্তম কোন সম্পদ নাই।"[২]
.
অর্থাৎ দীনদার স্ত্রী হল একজন পুরুষের নিকট অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। এখন যদি এই সম্পদকে "শস্যক্ষেত্র" বলা হয়, তবে স্বামী এখানে "কৃষক" এর ভূমিকা পালন করছে। আর একজন কৃষকের নিকট শস্যক্ষেত্রই হল উত্তম সম্পদ; আর তাই কৃষক যথাসাধ্য চেষ্টা করবে তার সেই সম্পদ (শস্যক্ষেত্র) এর সর্বোচ্চ পরিচর্যা করা। তাহলে এখানে "শস্যক্ষেত্র" রূপকটি প্রকৃতপক্ষে স্ত্রী হিসেবে নারীর মর্যাদা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে! কিন্তু ইসলামবিদ্বেষীদের এই মর্যাদার দৃষ্টিভঙ্গি কখনও মাথায় আসে না!!!
.
দ্বিতীয়ত, //শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছে গমন করতে পার//, এই অংশের ব্যাখ্যা বুঝতে হলে আমাদের এর প্রসঙ্গ দেখা জরুরি।
তাফসিরে আহসানুল বয়ানে এই আয়াতের তাফসিরে এক স্থানে বলা হচ্ছে,
.
"ইয়াহুদীদের ধারণা ছিল যে, যদি মহিলাকে উপুড় করে পিছনের দিক থেকে তার সাথে সঙ্গম করা হয়, তাহলে (সেই সঙ্গমে সন্তান জন্ম নিলে) তার চক্ষু টেরা হয়। এই ধারণার খন্ডনে বলা হচ্ছে যে, সহবাস সামনের দিক থেকে কর অথবা পিছনের দিক থেকে কর, যেভাবে ইচ্ছা কর সবই বৈধ। তবে সর্বক্ষেত্রে অত্যাবশ্যক হল নারীর যোনিপথ ব্যবহার করা। কেউ কেউ এ থেকে প্রমাণ করেন যে, 'যেভাবে ইচ্ছা' কথার মধ্যে মলদ্বারও এসে যায়। কাজেই স্ত্রীর মলদ্বার ব্যবহারও বৈধ। কিন্তু এটা একেবারে ভুল কথা। যখন কুরআন মহিলাকে শস্যক্ষেত (সন্তান উৎপাদনের ক্ষেত) সাব্যস্ত করল, তখন এর পরিষ্কার অর্থ হল, কেবল ক্ষেতকে ব্যবহারের জন্য বলা হচ্ছে যে, "নিজেদের শস্যক্ষেতে যেভাবে ইচ্ছা গমন কর।" আর এই ক্ষেত (সন্তান জন্মের স্থান) কেবল যোনিপথ, মলদ্বার নয়। মোটকথা, পায়ুমৈথুন একটি রুচি ও প্রকৃতি-বিরোধী কাজ। (তা ছাড়া হাদীসে আমাদেরকে বলা হয়েছে যে, স্ত্রীর পায়খানাদ্বারে সঙ্গম করা এক প্রকার কুফরী এবং) যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর মলদ্বার ব্যবহার করে, সে অভিশপ্ত।" (ইবনে কাসীর, ফাতহুল ক্বাদীর)[৩]
.
অর্থাৎ এখানে //যেভাবে ইচ্ছে গমন করতে পার// বলতে প্রকৃতপক্ষে সহবাসের ধরণের কথা বলা হচ্ছে যে, কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতি নেই যে সেভাবেই সহবাস করতে হবে। এখানে যৌন নির্যাতনের কোনো প্রসঙ্গই নেই।
এই প্রসঙ্গে তাফসির আবু বকর যাকারিয়াতে উল্লেখ করা হচ্ছে,
.
"আল্লাহ্‌ এখানে স্ত্রীদের সাথে সংগমের কোন নিয়মনীতি বেঁধে দেননি। শুইয়ে, বসিয়ে, কাত করে সব রকমই জায়েয। তবে যৌনাঙ্গ ছাড়া অন্যান্য অঙ্গ যেমন, পায়ূপথ, মুখ ইত্যাদিতে সংগম করা জায়েয নেই। কেননা, তা বিকৃত মানসিকতার ফল। এ ব্যাপারে বিভিন্ন হাদীসে নিষেধ এসেছে।"[৪]
.
তবে ইসলামবিদ্বেষীরা তাদের বিকৃত চিন্তার সমর্থনের জন্য কোরআন এর উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রায়ই এই হাদিসটি পেশ করে:
.
"আবূ হুরাইরাহ (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে তার সাথে বিছানায় শোয়ার জন্য আহবান করার পর যদি স্ত্রী না আসে এবং স্বামী তার উপর অসন্তুষ্ট অবস্থায় রাত কাটায়, তাহলে সকাল পর্যন্ত ফিরিশতাগণ ঐ স্ত্রীকে অভিসম্পাত করতে থাকেন।"[৫]
.
ইসলামবিদ্বেষীরা হয়ত বলতে পারে যে, এখানে স্বামীর আহবানে সাড়া না দিলে ফিরিশতা অভিশাপ করবে বলে ভয় দেখানো হচ্ছে, আর এভাবে নারীকে পাপের ভয় দেখিয়ে বাধ্য করা হচ্ছে!
.
এই বিষয়টির উত্তর দিতে আমরা কয়েকটি ধাপ দেখব।
প্রথমত, এক্ষেত্রে ইসলামবিদ্বেষীদের অজ্ঞতা হল, তারা ফিরিশতাদের অভিসম্পাত দেওয়ার হাদিসটা খুব বোঝে, কিন্তু কোরআন এর এই আয়াতখানা তাদের যেন মাথাতেই ঢোকে না!!!
.
لَا يُكَلِّفُ ٱللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَاۚ لَهَا مَا كَسَبَتْ وَعَلَيْهَا مَا ٱكْتَسَبَتْۗ رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَآ إِن نَّسِينَآ أَوْ أَخْطَأْنَاۚ رَبَّنَا وَلَا تَحْمِلْ عَلَيْنَآ إِصْرًا كَمَا حَمَلْتَهُۥ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِنَاۚ رَبَّنَا وَلَا تُحَمِّلْنَا مَا لَا طَاقَةَ لَنَا بِهِۦۖ وَٱعْفُ عَنَّا وَٱغْفِرْ لَنَا وَٱرْحَمْنَآۚ أَنتَ مَوْلَىٰنَا فَٱنصُرْنَا عَلَى ٱلْقَوْمِ ٱلْكَٰفِرِينَ
.
"কোন ব্যক্তিকেই আল্লাহ তার সাধ্যের অতিরিক্ত কর্তব্য পালনে বাধ্য করেন না; সে যা উপার্জন করেছে তা তারই জন্য এবং যা সে অর্জন করেছে তা তারই উপর বর্তাবে। (হে মুমিনগণ তোমরা এরূপে দুয়া করো) হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা যদি ভুলে যাই অথবা ভুল করি সেজন্য আমাদেরকে অপরাধী করবেন না। হে আমাদের রাব্ব! আমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর যেরূপ গুরুভার অর্পণ করেছিলেন আমাদের উপর তদ্রুপ ভার অর্পণ করবেননা। হে আমাদের প্রতিপালক! যা আমাদের শক্তির বাইরে ঐরূপ ভার বহনে আমাদেরকে বাধ্য করবেন না, এবং আমাদের পাপ মোচন করুন ও আমাদেরকে ক্ষমা করুন, আমাদেরকে দয়া করুন, আপনিই আমাদের আশ্রয়দাতা! অতএব কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে জয়যুক্ত করুন।"[৬]
.
এই আয়াতের //কোন ব্যক্তিকেই আল্লাহ তার সাধ্যের অতিরিক্ত কর্তব্য পালনে বাধ্য করেন না// অংশ থেকে তাই স্পষ্ট বোঝা যায় যে, যদি স্ত্রী শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকে বা কোনো কারণে সক্ষম না হয়, তবে স্বামীর যৌন আকাঙ্ক্ষায় সাড়া না দিলে তার গুনাহ হচ্ছে না, কারণ আল্লাহ তাআলা ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনি সাধ্যের অতিরিক্ত কর্তব্য পালনে বাধ্য করেন না। কিন্তু স্ত্রী সক্ষম, অথচ তবুও সে স্বামীর ডাকে সাড়া দেয় না, সেক্ষেত্রে সে গুনাহ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না!
.
দ্বিতীয়ত, ইসলামে বিয়ে করার ক্ষেত্রে নারীকে জোর করা হচ্ছে না। নারী নিজের ইচ্ছাতেই বিয়ে করছে।
মহান আল্লাহ বলেন,
.
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا يَحِلُّ لَكُمْ أَن تَرِثُوا۟ ٱلنِّسَآءَ كَرْهًاۖ وَلَا تَعْضُلُوهُنَّ لِتَذْهَبُوا۟ بِبَعْضِ مَآ ءَاتَيْتُمُوهُنَّ إِلَّآ أَن يَأْتِينَ بِفَٰحِشَةٍ مُّبَيِّنَةٍۚ وَعَاشِرُوهُنَّ بِٱلْمَعْرُوفِۚ فَإِن كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَىٰٓ أَن تَكْرَهُوا۟ شَيْـًٔا وَيَجْعَلَ ٱللَّهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا
.
"হে মুমিনগণ! জোরজবরদস্তি করে তোমাদের নিজেদেরকে নারীদের উত্তরাধিকারী গণ্য করা বৈধ নয়। তোমরা তাদেরকে যা দিয়েছ তা থেকে কিছু আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে তাদেরকে আটক রেখো না; যদি না তারা প্রকাশ্য অশ্লীলতা (ব্যভিচার বা স্বামীর অবাধ্যাচরণ) করে। আর তাদের সাথে সৎভাবে জীবন যাপন কর; তোমরা যদি তাদেরকে ঘৃণা কর, তাহলে এমন হতে পারে যে, আল্লাহ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন, তোমরা তাকে ঘৃণা করছ।"[৭]
.
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে আহসানুল বয়ানের এক স্থানে বলা হয়েছে,
.
"ইসলাম আসার পূর্বে মহিলার প্রতি এই অবিচারও করা হত যে, স্বামী মারা গেলে তার (স্বামীর) পরিবারের লোকেরা সম্পদ-সম্পত্তির মত এই মহিলারও জোরপূর্বক উত্তরাধিকারী হয়ে বসত এবং নিজ ইচ্ছায় তার সম্মতি ছাড়াই তাকে বিবাহ করে নিত অথবা তাদের কোন ভাই ও ভাইপোর সাথে তার বিয়ে দিয়ে দিত। এমন কি সৎ বেটাও মৃত পিতার স্ত্রী (সৎ মা)-কে বিবাহ করত অথবা ইচ্ছা করলে তাকে অন্য কোথাও বিবাহ করার অনুমতি দিত না এবং সে তার পূর্ণ জীবন বিয়ে ছাড়াই (বিধবা অবস্থায়) অতিবাহিত করতে বাধ্য হত। ইসলাম এই ধরনের সমস্ত প্রকারের যুলুম থেকে নিষেধ করেছে।"[৮]
.
এছাড়াও এ মর্মে হাদিসে উল্লেখ করা হচ্ছে:
.
"মু’আয বিন ফদালা (রহঃ) ... আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোন বিধবা নারীকে তার সম্মতি ছাড়া শাদী দেয়া যাবে না এবং কুমারী মহিলাকে তার অনুমতি ছাড়া শাদী দিতে পারবে না। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! কেমন করে তার অনুমতি নেব। তিনি বললেন, তার চুপ করে থাকাটাই তার অনুমতি।"[৯]
.
"আমর ইবনু রবী (রহঃ) ... আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! নিশ্চয়ই কুমারী মেয়েরা লজ্জাশীলা। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তার চুপ থাকাটাই তার সম্মতি।"[১০]
.
"আলী ইবনু আবদুল্লাহ (রহঃ) ... সাবিত আল বুনানী (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আনাস (রাঃ) এর কাছে ছিলাম। তখন তাঁর কাছে তাঁর কন্যাও ছিলেন। আনাস (রাঃ) বললেন, একজন মহিলা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে সমর্পণ করতে এসে বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনার কি আমার প্রয়োজন আছে? এ কথা শুনে আনাস (রাঃ) এর কন্যা বললেন, সে মহিলা তোমার চেয়ে উত্তম, সে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহচর্য পেতে আকৃষ্ট হয়েছিল। এ কারণেই সে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে নিজেকে পেশ করেছে।"[১১]
.
এই হাদিসগুলো থেকে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি যে, একজন ইসলামে একজন নারী নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করে তার জীবনসঙ্গী বেছে নিতে পারছে এবং কেউ তাকে জোর করছে না।
.
এখন নিজের ইচ্ছায় নিজের জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার পর যদি বিয়ের পর তার স্বামী তাকে সহবাসের জন্য আহবান করে আর সে সেই আহবানে সাড়া না দেয়, তাহলে সে বিয়ে করতে গেল কী কারণে? সে নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করল আর স্বামী আহবান করলে প্রত্যাখান করল, এর অর্থ এটাই দাঁড়ায় যে, সে আসলে বিয়ে করেছে স্বামীকে নিজের খুশিমত ব্যবহার করার জন্য। তাহলে স্বামী কি এখানে কোনো পণ্যদ্রব্য যে তাকে ইচ্ছামত ব্যবহার করতে হবে? যেখানে নারীকে স্ত্রী হিসেবে সম্পদ বলে আখ্যায়িত করে সম্মান দেওয়া হয়েছে, সেখানে সেই নারীর কী এতটুকু কৃতজ্ঞতাবোধ ও দায়িত্ব নেই যে, সে তার নিজের ইচ্ছায় বেছে নেওয়া বিবাহিত জীবনসঙ্গীকে পণ্যদ্রব্যের মত ব্যবহার না করে ভালবাসার মানুষ হিসেবে বিবেচনা করবে এবং তার আহবানে সাড়া দিয়ে তাকে খুশি রাখার চেষ্টা করবে? এটা কেমনতর দ্বিমুখী চিন্তা যে নারী কেবল একাই সুযোগ ভোগ করবে এবং স্বামী বেচারা তার শারীরিক যন্ত্রণায় পাগল হয়ে অন্য নারীর প্রতি আকৃষ্ট হবে আর ব্যভিচারের দিকে ছুটবে?
.
নিশ্চয়ই এটা সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো মানুষের কাছে স্বাভাবিক বিষয় হতে পারে না! আর একারণে এহেন বিকৃত পরিস্থিতির সৃষ্টি করার কারণে নারীর প্রতি ফিরিশতাগণের অভিসম্পাতের কথা এসেছে, কেননা এহেন পরিস্থিতে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক বিনষ্ট হয় আর তারা ব্যভিচারের দিকে ছুটে যায়, যেখানে ইসলামে ব্যভিচার পুরোপুরি নিষিদ্ধ!
.
হাদিসটির বর্ণনা আরেকবার দেখুন:
//কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে তার সাথে বিছানায় শোয়ার জন্য আহবান করার পর যদি স্ত্রী না আসে এবং স্বামী তার উপর অসন্তুষ্ট অবস্থায় রাত কাটায়, তাহলে সকাল পর্যন্ত ফিরিশতাগণ ঐ স্ত্রীকে অভিসম্পাত করতে থাকেন।//
.
এখানে আরও ভালভাবে খেয়াল করলে দেখবেন যে, স্ত্রীর প্রতি কেবল আধ্যাত্মিক বিষয়ের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে ফিরিশতার মাধ্যমে, কিন্তু কোথাও কি বলা হয়েছে যে, স্বামী তার স্ত্রীর ওপর ঝাপিয়ে পড়তে পারবে আর তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাতে পারবে??? না কোথাও তা বলা হয়নি। বরং শুধু এতটুকুই বলা হয়েছে যে, //স্বামী তার উপর অসন্তুষ্ট অবস্থায় রাত কাটায়।//
.
যদি ভালভাবে দেখা হয়, তবে অন্য হাদিসে স্ত্রীকে জোর করে শারীরিক সঙ্গমে বাধ্য করার বিরুদ্ধে বলা হয়েছে।
.
ইমাম দাইলামি(রহ.) আনাস বিন মালিক(রা.) এর বরাতে একটি হাদিস লিপিবদ্ধ করেছেন যে রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণনা করা হয়েছে যে,
.
**"কেউ যেন পশুর মতো তার স্ত্রী হতে নিজের যৌন চাহিদাকে পূরণ না করে,** বরং তাদের মধ্যে চুম্বন এবং কথাবার্তার দ্বারা শৃঙ্গার হওয়া উচিত।"[১২]
.
তাহলে স্ত্রীর ওপর পশুর মত ঝাপিয়ে পড়ে তার ওপর যৌন নির্যাতন চালানো ইসলামে অনুমোদিত নয়। এমনকি স্বামী কেবল নিজের চাহিদা পূরণ করার জন্য স্ত্রীকে ব্যবহার করতে পারবে না, বরং স্ত্রীর চাহিদার প্রতিও তাকে খেয়াল রাখতে হবে।
.
আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত:
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
.
"যখন পুরুষ তার স্ত্রীর সাথে সহবাস করে তখন সে যেন পরিপূর্ণভাবে (সহবাস) করে। আর তার যখন চাহিদা পূরণ হয়ে যায় (শুক্রস্খলন হয়) অথচ স্ত্রীর চাহিদা অপূর্ণ থাকে, তখন সে যেন তাড়াহুড়া না করে।"[১৩]
.
এখন ইসলামবিদ্বেষীরা যখন এই যৌন নির্যাতনের ব্যাখ্যায় সফল হল না, তখন তারা পালটা আরেকটা জিনিস দেখানো শুরু করে। আর সেটা হল, ইসলামে স্বামী তার স্ত্রীকে মারপিট করতে পারবে। তারা প্রথমেই কোরআন থেকে উদ্ধৃতি দেখায় যেখানে আল্লাহ তাআলা বলছেন,
.
ٱلرِّجَالُ قَوَّٰمُونَ عَلَى ٱلنِّسَآءِ بِمَا فَضَّلَ ٱللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ وَبِمَآ أَنفَقُوا۟ مِنْ أَمْوَٰلِهِمْۚ فَٱلصَّٰلِحَٰتُ قَٰنِتَٰتٌ حَٰفِظَٰتٌ لِّلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ ٱللَّهُۚ وَٱلَّٰتِى تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَٱهْجُرُوهُنَّ فِى ٱلْمَضَاجِعِ وَٱضْرِبُوهُنَّۖ فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلَا تَبْغُوا۟ عَلَيْهِنَّ سَبِيلًاۗ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلِيًّا كَبِيرًا
.
"পুরুষেরা নারীদের উপর তত্ত্বাবধানকারী ও ভরণপোষণকারী, যেহেতু আল্লাহ তাদের মধ্যে একের উপর অপরকে বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এই হেতু যে, তারা স্বীয় ধন সম্পদ হতে তাদের জন্য ব্যয় করে থাকে; সুতরাং যে সমস্ত নারী পুণ্যবতী তারা আনুগত্য করে, আল্লাহর সংরক্ষিত প্রচ্ছন্ন বিষয় সংরক্ষণ করে; যদি নারীদের অবাধ্যতার আশংকা হয় তাহলে তাদেরকে সদুপদেশ প্রদান কর, তাদেরকে শয্যা হতে পৃথক কর এবং তাদেরকে (মৃদুভাবে) প্রহার কর; অনন্তর যদি তারা তোমাদের অনুগত হয় তাহলে তাদের জন্য অন্য পন্থা অবলম্বন করনা; নিশ্চয়ই আল্লাহ সমুন্নত, মহা মহীয়ান।"[১৪]
.
এই আয়াতে আমরা এই অংশটুকু দেখতে পাই,
//যদি নারীদের অবাধ্যতার আশংকা হয় তাহলে তাদেরকে সদুপদেশ প্রদান কর, তাদেরকে শয্যা হতে পৃথক কর এবং তাদেরকে (মৃদুভাবে) প্রহার কর//
.
এখানে ইসলামবিদ্বেষীরা বলতে চায় যে, ইসলাম স্বামীকে অনুমতি দেয় নারীকে মারধরের জন্য।
.
আসুন আমরা দেখি ইসলাম ঠিক কেমনতর মারার অধিকার স্বামীকে দিয়েছে।
.
এই বিষয়টির উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রেও আমরা কয়েকটি ধাপের অনুসরণ করব।
.
এই আয়াতের প্রথম দিকে আমরা দেখতে পাই,
//পুরুষেরা নারীদের উপর তত্ত্বাবধানকারী ও ভরণপোষণকারী...//
অর্থাৎ নারীকে পুরুষের অধীনস্থ করা হয়েছে। আর এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে //যেহেতু আল্লাহ তাদের মধ্যে একের উপর অপরকে বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এই হেতু যে, তারা স্বীয় ধন সম্পদ হতে তাদের জন্য ব্যয় করে থাকে..//
.
এখানে মূল বিষয়টি হল, পুরুষকে আল্লাহ তাআলা কিছু অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য দিয়েছেন যেটা নারীকে দেননি। কিন্তু এটা থেকে ইসলামবিদ্বেষী এই অর্থ করে নেয় যে, ইসলামে পুরুষ নারীর থেকে শ্রেষ্ঠ, আর নারী নিকৃষ্ট! ব্যাপারটা মোটেও এমন নয়। মনে করা যাক, দুইজন শিক্ষকের মধ্যে একজন পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক, আর একজন ইংরেজির শিক্ষক। দুইজনের পদই কলেজে সমান। তারা সমান বেতন পান আর সমান পদমর্যাদাও পান। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসরকে হয়ত একটু বেশি খাটতে হচ্ছে, তার পদার্থবিজ্ঞানের প্রাকটিকাল ক্লাস আর টিউশন ক্লাস এর চাপ যত বেশি, ততখানি চাপের অর্ধেকেরও কম চাপ আর দায়িত্ব ইংরেজির প্রফেসরকে পালন করতে হয়। কিন্তু তাদের পদমর্যাদা কলেজে সমান।
.
তবে এক্ষেত্রে কারও দায়িত্ব যদি বেশি হয়, তবে সেই বেশি দায়িত্বের জন্য তিনি সেই পর্যায়ের কাজের জন্য সম্মান পাচ্ছেন। যেমন পদার্থবিজ্ঞানের স্যার হয়ত তার স্টুডেন্টদের প্রাকটিকাল ক্লাস করানোর সময় যে সম্মান পাচ্ছেন সেটা ইংরেজির স্যার পাবেন না। কারণ ইংরেজির স্যারকে প্র‍্যাকটিকাল করাতে হয় না। কিন্তু তবুও দুইজন স্যারের পদমর্যাদা কম হচ্ছে না। কারণ তাদের কর্মক্ষেত্র আসলে আলাদা, কিন্তু পদমর্যাদা আসলে সমান।
.
একইভাবে নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে পুরুষের দায়িত্ব হয়ত কিছুটা বেশি। যেমন তাকে সর্বদা সালাত বা নামাজ আদায় করতে হবে, যেটা নারীকে হায়েয বা ঋতুস্রাব চলাকালীন করতে হচ্ছে না। পুরুষকে রমজানে রোজা রাখতে হবে যেটা নারীকে গর্ভবতী অবস্থায় রাখতে হচ্ছে না। পুরুষের জন্য সংসারের জন্য উপার্জন বাধ্যতামূলক, যেটা নারীর জন্য বাধ্যতামূলক নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই এক্ষেত্রে পুরুষ হয়ত কিছুটা অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছে আর এর জন্য অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য সে লাভ করেছে, আর একারণে সেই অতিরিক্ত দায়িত্বের জন্য সেই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কিছু অতিরিক্ত মর্যাদা পাচ্ছে; কিন্তু সেটা পুরুষের নিজস্ব অবস্থানে সে পাচ্ছে, সেটা নারীর অবস্থানের থেকে আলাদা, তাই নারীর সাথে তার অতিরিক্ত মর্যাদা তুলনীয় নয়; যেমনটা পদার্থবিজ্ঞানের প্রাকটিকাল ক্লাসে স্যারের মর্যাদার সাথে ইংরেজি প্রফেসর এর মর্যাদা কম বলা যায় না। এক্ষেত্রে নারী ও পুরুষকে তাদের নিজ নিজ অবস্থানের দায়িত্ব ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে নিজ নিজ অবস্থানে বিচার করা হবে এবং সমগ্র বিচারের মানদণ্ড হবে "তাকওয়া" (অর্থাৎ আল্লাহভীরুতা, ন্যায়পরায়ণতা, ধার্মিকতা ইত্যাদি)। আল্লাহ বলেন,
.
يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَٰكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَىٰ وَجَعَلْنَٰكُمْ شُعُوبًا وَقَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوٓا۟ۚ إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ ٱللَّهِ أَتْقَىٰكُمْۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
.
"হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদা সম্পন্ন যে অধিক তাকওয়া এর অধিকারী। আল্লাহ সব কিছু জানেন, সব কিছুর খবর রাখেন।"[১৫]
.
এক্ষেত্রে তাই যখন বলা হচ্ছে //পুরুষেরা নারীদের উপর তত্ত্বাবধানকারী ও ভরণপোষণকারী যেহেতু আল্লাহ তাদের মধ্যে একের উপর অপরকে বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এই হেতু যে, তারা স্বীয় ধন সম্পদ হতে তাদের জন্য ব্যয় করে থাকে..//, তখন এখানে পুরুষকে অভিভাবক পদে এবং নারীকে তার অধীনস্থ হিসাবে নিযুক্ত করা হচ্ছে, কিন্তু উপরিউক্ত আয়াত অনুযায়ী মর্যাদার মানদণ্ড হচ্ছে "তাকওয়া"। অর্থাৎ এখানে পুরুষ ও নারীর নিজ নিজ অবস্থান ও ভূমিকা পৃথক করা হয়েছে। নারীর জন্য বাধ্যতামূলক নয় অর্থ উপার্জন করা, কিন্তু পুরুষের জন্য সেটা বাধ্যতামূলক। বিষয়টি নিম্নোক্ত হাদিস থেকে আরও ভাল বোঝা যায়:
.
"‘আবদুল্লাহ্ ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত।নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা প্রত্যেকেই রক্ষক এবং তোমরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞাসিত হবে। একজন শাসক সে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।
.
**একজন পুরুষ তার পরিবারের রক্ষক, সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।**
.
**একজন স্ত্রী তার স্বামীর গৃহের রক্ষক, সে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।**
.
একজন গোলাম তার মনিবের সম্পদের রক্ষক, সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব সাবধান, তোমরা প্রত্যেকেই রক্ষক এবং তোমরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞাসিত হবে।"[১৬]
.
অর্থাৎ এই হাদিস থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, স্বামী যেমন তার পরিবারের রক্ষক, তেমনি স্ত্রী তার স্বামীর গৃহের রক্ষক। একারণে আল্লাহ বলেন,
.
هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ
.
"তারা (স্ত্রীরা) তোমাদের (স্বামীদের) জন্য আবরণ এবং তোমরা (স্বামীরা) তাদের (স্ত্রীদের) জন্য আবরণ।’’[১৭]
.
অর্থাৎ এখানে সম্পর্কটা হল mutual understanding বা পারস্পরিক সমঝোতার মত। এখানে কারও ওপর কোনো নির্যাতনের ব্যাপার নেই।
.
আয়াতের প্রধান অভিযোগ ছিল এই স্থানটিতে,
//যদি নারীদের অবাধ্যতার আশংকা হয় তাহলে তাদেরকে সদুপদেশ প্রদান কর, তাদেরকে শয্যা হতে পৃথক কর এবং তাদেরকে (মৃদুভাবে) প্রহার কর//
.
এখন এখানে পূর্বে আমরা দেখেছি যে, স্বামী-স্ত্রীর নিজ নিজ অবস্থান স্বতন্ত্র এবং তাদের সম্পর্কও পারস্পরিক সমঝোতার মধ্যে আবদ্ধ। তবে এক্ষেত্রে প্রহারের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় আসে-
১) প্রহার কোন পরিস্থিতিতে হবে?
২) প্রহার কেন হবে?
.
বিষয়টিকে বুঝতে আমরা আরেকটি হাদিস দেখব।
.
"...নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, শোন, তোমরা স্ত্রীদের কল্যাণের ওয়াসীয়ত গ্রহণ কর। তারা তো তোমাদের কাছে বন্দী। তা ছাড়া আর কোন বিষয়ে তোমরা তাদের মালিক নও।
.
**কিন্তু তারা যদি সুষ্পষ্ট অশ্লীল কাজে লিপ্ত হয় তবে ভিন্ন কথা।**
.
**তারা যদি তা করে তবে তাদের শয্যায় তাদের আলাদা রাখবে, মৃদু প্রহার করবে, কঠোরভাবে নয়।**
.
তারপর তারা যদি তোমাদের আনুগত্য করে তবে আর তাদের বিরুদ্ধে উত্যক্ত করার জন্য পথের খোঁজ করবে না।
.
**সাবধান! তোমাদের স্ত্রীদের তোমাদের হক রয়েছে আর তোমাদের স্ত্রীদেরও তোমাদের উপর হক রয়েছে।**
.
স্ত্রীদের উপর তোমাদের হক হলো, যাদের তোমরা অপছন্দ কর, তাদের তোমাদের ঘরে স্থান দিবে না অথবা যাদের তোমরা অপছন্দ কর, তাদের গৃহে অনুমতি দিবে না। শোন, তোমাদের উপর স্ত্রীদের হক হলো, তাদের খোর পোষের ক্ষেত্রে তাদের প্রতি উত্তম আচরণ করবে।"[১৮]
.
অর্থাৎ এই হাদিস থেকে আমরা দেখতে পাই যে, স্ত্রী যদি সুস্পষ্টভাবে কোনো অশ্লীল কাজে লিপ্ত হয়, তবেই তাকে প্রহার করা যাবে। তবে সেটা কঠোরভাবে নয়, বরং মৃদুভাবে। আর এটা একবারে করা যাবে না। বরং তাকে আগে বুঝাতে হবে, এরপরও অশ্লীলতা আর হারামে মত্ত থাকলে শয্যা ত্যাগ করতে হবে। আর তারপরও অশ্লীলতা না থামালে মৃদুভাবে প্রহার করতে হবে।
.
কিন্তু স্ত্রী যদি অশ্লীলতার মত হারামে মত্ত না হয়, তবে তাকে প্রহার করা অনুমোদিত নয়।
.
এখন এখানে প্রহার মৃদুভাবে বলতে কী বোঝানো হচ্ছে?
.
"মুহাম্মাদ ইবনু ইউসুফ (রহঃ) ... আবদুল্লাহ‌ ইবনু যাম’আ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
তোমরা কেউ নিজ স্ত্রীদেরকে গোলামের মতো প্রহার করো না। কেননা, দিনের শেষে তার সাথে তো মিলিত হবে।"[১৯]
.
অর্থাৎ এখানে বলা হচ্ছে যে, জাহেলিয়াত এর যুগে অজ্ঞ লোকেরা যেভাবে গোলাম বা দাসদের ইচ্ছামত মারত, স্ত্রীকে সেভাবে মারা নিষিদ্ধ। আগের হাদিসে আমরা //তারা তো তোমাদের কাছে বন্দী// অংশটুকু দেখেছিলাম যেটা দেখে অনেকে দাবি করতে পারে যে, স্ত্রী হল দাসীর মত; কিন্তু এই হাদিস থেকে এটাও প্রমাণিত হল যে, স্ত্রী গোলাম বা দাসের পর্যায়ের নয়। বরং ইসলামেও দাসদের পৃথক অবস্থান ও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তাই এখানে "বন্দী" কথাটি রূপক অর্থে ব্যবহার করে নারীর গৃহকর্ত্রীর অবস্থান ও স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্যকে তুলে ধরা হয়েছে।
.
আরেকটি হাদিস বলছে,
.
"হাকিম ইবনু মুআবিয়াহ হতে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন-আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমাদের উপর স্ত্রীর হক কি? তিনি বললেন, তুমি যখন খাবে তোমার স্ত্রীকেও খাওয়াবে, আর যখন তুমি পোষাক পরবে তাকেও পোষাক পরাবে।
.
**আর মুখে আঘাত করবে না,**
.
তাকে অশ্লীল ভাষায় গালি দিবে না, তার সাথে চলাফেরা, কথাবার্তা বর্জন করবে না- তবে বাড়ির মধ্যে রেখে তা করতে পারবে। --বুখারী এ হাদীসের কিছু অংশকে মুয়াল্লাক (সানাদ বিহীন) রূপে বর্ণনা করেছেন। ইবনু হিব্বান ও হাকিম একে সহীহ বলেছেন।"[২০]
.
অর্থাৎ এখানে স্ত্রীর মুখেও মারা যাবে না। এটা নিষিদ্ধ।
.
অন্য একটি হাদিসে একেবারেই প্রহার না করার কথা বলা হচ্ছে,
.
"মু‘আবিয়াহ আল-কুশাইরী (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বললাম, আমাদের স্ত্রীদের (হক) সম্পর্কে আপনি কি বলেন? তিনি বললেনঃ তোমরা যা খাবে তাদেকেও তা খাওয়াবে এবং তোমরা যা পরবে, তাদেরকেও তা পরিধান করাবে। তাদেরকে প্রহার করবে না এবং গালিগালাজ করবে না।"[২১]
.
এগুলো থেকে বোঝা যায় যে, ইসলাম প্রকৃতপক্ষে স্ত্রীকে প্রহার করার অনুমতি দেয় নি। এক্ষেত্রে কোরআন এর উক্ত আয়াত অর্থাৎ সূরা নিসা এর ৩৪ নং আয়াতে তাই "প্রহার করো" বা "দারাবা" শব্দটি দিয়ে আক্ষরিক অর্থে প্রহার বা মারা বোঝানো হয়নি, বরং এটি হাদিসের ব্যাখ্যা অনুযায়ী কেবল একটি "রূপক প্রহার" বা "symbolic beating"; অর্থাৎ প্রহার করার ক্ষেত্রে মুখে মারা যাবে না, এমনভাবে মারা যাবে না যাতে শরীরের ক্ষতি হয়, গোলামের মত মনে করে মারা যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। বরং খুবই মৃদুভাবে মারতে হবে। তাই মারাটা আসলে যেন মারাই নয়। একারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে এহেন প্রহার করতে নিষেধ করেছেন। ইবনে আব্বাস এর মত বিশেষজ্ঞরা তাই এখানে মারা বলতে মেসওয়াক অর্থাৎ এক ধরণের প্রাকৃতিক টুটব্রাশ দিয়ে মৃদু প্রহারের সাথে ব্যাপারটিকে তুলনা করেছেন।
.
যেমন ধরুন যদি ছোট ছেলে বলে যে সে সুপারম্যান হবে আর ছাদ থেকে লাফ দেবে, তখন বাবা প্রথমে তাকে ভাল করে বোঝাবে। এবার দেখা গেল ছেলে শুনল না আর পীড়াপীড়ি শুরু করল ছাদ থেকে লাফ দেওয়ার জন্য। তখন হয়ত আরও একটু কড়াভাবে বলতে পারে। আর যদি ছেলে ছাদে গিয়ে লাফ দেবে দেবে এমন অবস্থা হয়, তখন বাবা তাকে থামানোর জন্য সামান্য মারতে পারে ছেলে বাঁচানোর জন্য আর তাকে শুধরানোর জন্য। বাবা চাইবে না যে তার ছেলে মারা যাক আর এটাও চাইবে না যে, তার ছেলেকে মারার ফলে সে গুরুতর আঘাত পাক। এখানে কেবল ছেলে সঠিক পথে আনতে বাবাকে কঠোর হতে হচ্ছে।
.
একইভাবে আমরা আগের একটা হাদিসে দেখেছি যে, স্ত্রী যদি কেবল সুস্পষ্ট অশ্লীল কাজের মত হারাম কাজে লিপ্ত হয়, তবে তাকে প্রথমে বোঝাতে হবে, সে তারপরও হারামে লিপ্ত থাকতে শয্যা ত্যাগ করতে হবে, এরপরও না শুনলে মৃদুভাবে প্রহার করার অনুমতি আছে, তবে এটা বাধ্যতামূলক নয়,বরং নিন্দনীয়, কিন্তু অনুমোদিত। এখানে স্বামী তার রাগ মেটানোর জন্য স্ত্রীকে মারবে না, বরং আল্লাহর পথে ফিরিয়ে আনার জন্য স্ত্রীকে এহেন সামান্য প্রহার করছে যাতে করে সে অশ্লীলতা আর হারামের পথ থেকে ফিরে আসে। সাধারণ ক্ষেত্রে একেবারেই এমনতর হচ্ছে না। এটা হল চরম পর্যায় যখন স্ত্রী সুস্পষ্ট হারামে লিপ্ত। চিন্তা করুন, একজন পুরুষ দেখছে যে তার স্ত্রী অন্য পুরুষকে সঙ্গ দিচ্ছে আর এটা পাড়া প্রতিবেশীরাও জেনে গেছে। এখন সমাজে তার সম্মানটা নিয়ে টানাটানি হচ্ছে। সেই পর্যায়ে অনেক পুরুষই সাথে সাথে তার স্ত্রীকে মারধর শুরু করে দিতে পারে। কিন্তু ইসলাম প্রথমে বলছে যে, আগে তাকে ভালভাবে বোঝাও, না শুনলে শয্যা ত্যাগ করো, তারপরও না শুনলে মৃদুভাবে হালকা প্রহার করো যেন সেটা প্রহারই না! আর এরপরও সমঝোতা না এলে হয়ত বিবাহ বিচ্ছেদে তা রূপান্তরিত হতে পারে।
.
তবে এখানে অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন যে, পুরুষ যদি মৃদু প্রহার করতে পারে, নারী কেন পারবে না? উত্তরে আমরা বলব যে, ছেলেকে বাবা মারতে পারলে বাবাকে কেন ছেলে মারতে পারবে না? শিক্ষক ছাত্রকে মারতে পারলে ছাত্র কেন শিক্ষককে মারতে পারবে না? মা তার মেয়েকে মারলে মেয়ে কেন মাকে মারতে পারবে না? সৈন্যপ্রধান বা কমান্ডার তার সৈন্যদের শুধরানোর জন্য যদি দুটো কড়া কথা বলে, তাহলে সাধারণ একজন সৈন্য কেন পাল্টা কমান্ডারকে কটু কথা বলতে পারবে না? এর কারণ হল প্রত্যেকের অবস্থান এখানে স্বতন্ত্র, আর দায়িত্বও এখানে স্বতন্ত্র। ছেলে ভুল করলে বাবা শুধরানোর জন্য দুট কড়া কথা শুনাল। কিন্তু দেখা গেল যে, বাবা সিগারেট খায়, মদ খায়, নামাজ পড়ে না; কিন্তু ছেলে সেগুলো খায় না আর ঠিকমত নামাজ আদায় করে। তাহলে এখানে বাবা দুটো কথা শোনাতে পারে - এর মানে এই না যে বাবা উৎকৃষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বরং ইসলামে উৎকৃষ্টতার মানদণ্ড হল "তাকওয়া" যা সমগ্র পরিসরে বিচার্য হবে আর সেক্ষেত্রে বাবা শাসনের ক্ষমতা রাখলেও সমগ্র বিচারে ছেলে তাকওয়ার কারণে বেশি উৎকৃষ্টও হতে পারে। একইভাবে স্বামীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে স্ত্রীকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য, তাকে ভুল হলে শুধরানোর জন্য৷ এক্ষেত্রে তাই স্বামীর এই অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য আছে মানে এই না যে, স্বামী তার স্ত্রীর থেকে উৎকৃষ্ট হয়ে যাবে যেহেতু আমরা আগেই সূরা হুজুরাত এর একটি আয়াতে দেখেছি যে আল্লাহ তাআলার কাছে বিচারের মানদণ্ড হল তাকওয়া।
.
কিন্তু এক্ষেত্রে স্বামী এমন কোনো কাজ করতে পারবে না, যাতে করে স্ত্রী শারীরিকভাবে ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোরআন বলছে,
.
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا يَحِلُّ لَكُمْ أَن تَرِثُوا۟ ٱلنِّسَآءَ كَرْهًاۖ وَلَا تَعْضُلُوهُنَّ لِتَذْهَبُوا۟ بِبَعْضِ مَآ ءَاتَيْتُمُوهُنَّ إِلَّآ أَن يَأْتِينَ بِفَٰحِشَةٍ مُّبَيِّنَةٍۚ وَعَاشِرُوهُنَّ بِٱلْمَعْرُوفِۚ فَإِن كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَىٰٓ أَن تَكْرَهُوا۟ شَيْـًٔا وَيَجْعَلَ ٱللَّهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا
.
"হে মু’মিনগণ! এটা তোমাদের জন্য বৈধ নয় যে, তোমরা বলপূর্বক নারীদের উত্তরাধিকারী হও; এবং প্রকাশ্য অশ্লীলতা ব্যতীত তোমরা তাদেরকে যা প্রদান করেছ উহার কিয়দংশ গ্রহণের জন্য তাদেরকে বাধ্য কর না এবং তাদের সাথে সদ্ভাবে সম মর্যাদায় অবস্থান কর; কিন্তু যদি অপছন্দ কর তাহলে তোমরা যে বিষয় অপছন্দ কর আল্লাহ সেটাকে প্রচুর কল্যাণকর করতে পারেন।"[২২]
.
চিন্তা করুন, কোরআন বলছে যে, যদি স্ত্রীকে অপছন্দও হয়, তবুও তার সাথে সদ্ভাবে অবস্থান করতে। একই কথা এসেছে অন্য একটি হাদিসেও যেখানে বলা হচ্ছে,
.
"কোনো মু’মিন যেন মু’মিনাহ্-কে ঘৃণা না করে (বা তার প্রতি শত্রুতা পোষণ না করে); যদি তার কোনো আচরণে সে অসন্তোষ প্রকাশ করে, তবে অন্য আর এক আচার-ব্যবহারে সন্তুষ্টি লাভ করবে।"[২৩]
.
তাহলে ভেবে দেখুন, স্ত্রীর আচরণে, ক্রিয়াকলাপে, হারাম কাজে অসন্তুষ্ট হলেও ইসলাম বলছে তার মুমিন স্ত্রীর সাথে সদ্ভাবে জীবনযাপন করতে, তাকে ঘৃণা না করতে আর চরিত্রের খারাপ কোনো দিক পেলে ভাল দিকের অনুসন্ধান করতে। আর তাই আমাদের প্রশ্ন হল, স্ত্রীর সাথে সদ্ভাবে জীবনযাপনের অর্থ কি তাকে মেরে ফাটিয়ে দেওয়া ??? কখনই না। আর আগেই আমরা দেখেছি যে, স্ত্রীকে বেধরে মারার অনুমতি কখনই ইসলাম দেয় না!
.
আমরা আগেই দেখেছি যে, প্রকাশ্য অশ্লীলতার মত ভয়াবহ কোনো হারাম কাজে লিপ্ত না হলে মৃদু প্রহারটুকুও করা যাবে না। এমনকি এর আগে খুব ভালভাবে স্ত্রী বুঝাতে হবে কুপথ থেকে ফিরে আসার জন্য আর এরপর প্রয়োজনে শয্যা বর্জন করতে হবে। এরপর শেষ পর্যায়ে চূড়ান্ত অবস্থায় স্ত্রীকে শুধরানোর জন্য সামান্যতম প্রহারের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে যা আসলে প্রকৃতপক্ষে প্রহারই নয় বললেই চলে!
.
তবে এই চূড়ান্ত পর্যায় ব্যতীত অন্য কোনো ক্ষেত্রে স্ত্রীকে সামান্যতম প্রহারটুকুও করা যাবে না। এমনকি স্ত্রী যদি স্বামীর সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়, তবুও না। অনেকে মনে করে যে, ইসলাম হয়ত পুরুষকে অনুমতি দিচ্ছে যে, সামান্য ঝগড়া বিবাদ হলেই পুরুষ তার স্ত্রীকে মারতে পারবে! এটা থেকে বোঝাই যায় যে তারা আসলে ইসলামের কিছুই ঠিকমত বোঝে না! এই হাদিসটি খেয়াল করুন যেখানে স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী তাঁর সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হয়েছেন:
.
"‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত.....
....একদিন আমি আমার স্ত্রীকে ধমক দিলাম। সে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিউত্তর করল। আর এই প্রতিউত্তর আমার পছন্দ হল না। তখন সে আমাকে বলল, আমার প্রতিউত্তরে তুমি অসন্তুষ্ট হও কেন? আল্লাহর কসম! নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সহধর্মিণীরাও তো তাঁর কথার প্রতিউত্তর করে থাকেন এবং তাঁর কোন কোন সহধর্মিণী রাত পর্যন্ত পুরো দিন তাঁর কাছ হতে আলাদা থাকেন। এ কথা শুনে আমি ঘাবড়ে গেলাম। বললাম, যিনি এরূপ করেছেন তিনি অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তারপর আমি জামা-কাপড় পরে (আমার মেয়ে) হাফসাহ (রাযি.)-এর কাছে গিয়ে বললাম, হে হাফসা! তোমাদের কেউ কেউ নাকি রাত পর্যন্ত পুরো দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে অসন্তুষ্ট রাখে। সে বলল, হ্যাঁ। আমি বললাম, তবে তো সে বরবাদ এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তোমার কি ভয় হয় না যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসন্তুষ্ট হলে আল্লাহও অসন্তুষ্ট হবেন। এর ফলে তুমি বরবাদ হয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সঙ্গে বাড়াবাড়ি করো না এবং তাঁর কোন কথার প্রতিউত্তর দিও না এবং তাঁর হতে পৃথক থেক না। তোমার কোন কিছুর দরকার হয়ে থাকলে আমাকে বলবে...."[২৪]
.
হাদিসটি থেকে আমরা পুরোপুরি বুঝতে পারছি যে, স্বামীর সঙ্গে সামান্য বিবাদ হলে সেক্ষেত্রে মারার কোনো অনুমতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহ থেকে প্রমাণিত নয়।
.
অন্য একটি হাদিস বলছে,
.
"‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কোন এক আনসারী মহিলা তার মেয়েকে বিয়ে দিলেন। কিন্তু তার মাথার চুলগুলো উঠে যেতে লাগল। এরপর সে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে এ ঘটনা বর্ণনা করে বলল, তার স্বামী আমাকে বলেছে আমি যেন আমার মেয়ের মাথায় কৃত্রিম চুল পরিধান করাই। তখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না তা করো না, কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলা এ ধরনের মহিলাদের ওপর লা‘নত বর্ষণ করেন, যারা মাথায় কৃত্রিম চুল পরিধান করে।"[২৬]
.
অর্থাৎ এই হাদিস থেকে এটা প্রমাণিত যে, যদি স্বামী কোনো হারাম কাজের হুকুম দেয়, তবে তার স্ত্রী অবশ্যই তার প্রতিবাদ করতে পারবে আর এটা পুরোপুরি অনুমোদিত। অর্থাৎ একজন স্ত্রী তার স্বামীর ভুল কাজের প্রতিবাদ করতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে তাদের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতাবোধ ও শিষ্টাচার থাকা উচিৎ।
.
অনেক ইসলামবিদ্বেষী মূর্খের মত একটা হাদিস পেশ করে যেখানে নাকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সহধর্মিণী আয়েশা (রা)-কে প্রহার করেছেন বলে উল্লেখ করা আছে। চলুন হাদিসটি ভালভাবে দেখি।
.
"হারুন ইবনু সাঈদ আয়লী (রহঃ) ... মুহাম্মদ ইবনু কায়স (রহঃ) বলেন, আমি আয়িশা (রাঃ) কে বলতে শুনেছি যে, আমি কি তোমাদের কাছে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আমার সম্পর্কে বর্ণনা করব না? আমরা বললাম, হ্যাঁ, অবশ্যই বর্ণনা করুন। ইমাম মুসলিম (রহঃ) হাজ্জাজ আওয়ার (রহঃ) থেকে যিনি শুনেছেন এরূপ উস্তাদ থেকে ... জনৈক কুলায়শী আবদুল্লাহ (রহঃ) থেকে মুহাম্মদ ইবনু কায়স ইবনু মাখরামা ইবনু মুত্তালিব (রহঃ) সুত্রে বর্ণিত। তিনি একদিন বলেন, আমি কি তোমাদেরকে আমার ও আমার মায়ের কথা শুনাবো না? রাবী আবদুল্লাহ (রহঃ) বলেন, আমরা মনে করলাম, তিনি তার জন্মধাত্রী মায়ের কথা বলতে চাচ্ছেন।
.
এরপর তিনি বললেন, আয়িশা (রাঃ) বলেছেন, আমি কি তোমাদেরকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আমার কথা শুনাবো না? আমরা বললাম, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বর্ণনা করুন। রাবী বলেন তিনি বললেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার পালার যে রাতে আমার কাছে ছিলেন, সে রাতে তিনি বাইরে থেকে এসে চাঁদর রেখে দিলেন, জুতা খুলে নিলেন এবং জুতা দুটি তার পায়ের দিকে রেখে চাঁদরের এক কিনারা বিছানার উপর বিছিয়ে দিলেন এবং শুয়ে পড়লেন। তিনি এতটুকু সময় অপেক্ষা করেন যতটুকু সময়ে তিনি আমার ঘুমিয়ে পড়ার ধারণা করলেন।
.
তারপর অতি সন্তর্পণে চাদর নিলেন, জুতা পরলেন ও দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। তারপর সাবধানে দরজা বন্ধ করে চলে গেলেন। আমিও আমার উড়না মাথায় দিলাম, জামা পরে নিলাম এবং ইযার বেঁধে নিলাম। তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিছনে পিছনে রওনা হলাম। তিনি গারাকাদে বাকীতে পৌঁছে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন। তিনবার হাত উঠালেন। তারপর ফিরে আসতে লাগলেন, আমিও রওনা হয়ে পড়লাম। তিনি দ্রুতগতিতে আসতে লাগলেন, আমিও আমার গতি বাড়িয়ে দিলাম। তিনি দৌড়াতে শুরু করলেন আমিও দৌড়াতে লাগলাম। তিনি ঘরে এসে পৌছলেন, আমিও তাঁর পূর্বক্ষণে এসে পৌছলাম এবং ঘরে প্রবেশ করেই শুয়ে পড়ার সাথে সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে প্রবেশ করলেন এবং বললেন, হে আয়িশা! কী হয়েছে? তুমি ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস গ্রহণ করছ কেন? আমি বললাম, কিছুই না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি বলে দাও, নতুবা সর্বজ্ঞ সুক্ষ্মদর্শী আল্লাহ আমাকে জানিয়ে দিবেন।
.
আয়িশা (রাঃ) বলেন, তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমার পিতা-মাতা আপনার উপর কুরবান। অতঃপর ঘটনা বর্ণনা করলাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেলেন, আমার সামনে একটি মানুষের দেহের ছায়ার ন্যায় দেখা যাচ্ছিল তা হলে সে ছায়া তুমিই ছিলে? আমি বললাম, হ্যাঁ।
.
**তখন তিনি আমার বুকে একটি ধাক্কা মারলেন, তাতে আমি ব্যাথা পেলাম।**
.
তারপর বললেন, তুমি কি ধারণা করেছিলে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুল তোমার প্রতি অবিচার করবে? আয়িশা বললেন, হ্যাঁ, তাই। অনেক সময় মানুষ গোপন রাখতে চায়, আর আল্লাহ তা প্রকাশ করে দেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, জিবরীল (আলাইহিস সালাম) এসেছিলেন। যখন তুমি আমাকে বের হতে দেখেছিলে। এসে আমাকে তিনি ডাকলেন এবং তোমার থেকে ব্যাপার গোপন রাখতে চাইলেন। আমি তাঁর ইচ্ছানূযায়ী তোমার থেকে গোপন রাখলাম তিনি তোমার ঘরে প্রবেশ করতে চাচ্ছিলেন না যেহেতু তুমি কাপড় রেখে দিয়েছিলে।
.
আর আমি ধারণা করলাম তুমি ঘুমিয়ে পড়েছে, তাই তোমাকে জাগানো পছন্দ করি নি এবং আমার আশংকা হল তুমি (একাকীঁ) ভয় পাবে। জিবরীল (আলাইহিস সালাম) বললেন, আপনার রব আপনাকে আদেশ করেছেন, গারাকাদে বাকীতে গিয়ে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।
.
আয়িশা (রাঃ) বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! তাদের জন্য আমরা কী বলব? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এভাবে বলঃ "কবরবাসী মুমিন মুসলমানদের প্রতি সালাম, আল্লাহ অগ্রগামী পশ্চাৎগামী সবার প্রতি দয়া করুন আমরাও ইনশাআল্লাহ অবশ্য তোমাদের সাথে মিলিত হব।"[২৬]
.
.
ইসলামবিদ্বেষীদের আপত্তি এই অংশটুকুতে //তখন তিনি আমার বুকে একটি ধাক্কা মারলেন, তাতে আমি ব্যাথা পেলাম//
.
চলুন আমরা মা আয়েশা (রা) এর মুখেই শুনি উনি ধাক্কাকে কীভাবে গ্রহণ করেছেন।
.
"আবূ কুরায়ব (রহঃ) ... আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নিজ হাতে কোন দিন কাউকে মারেন নি, **কোন স্ত্রীলোককেও না,** খাদিমকেও না, আল্লাহর পথে জিহাদ ছাড়া। আর যে তার ক্ষতি করেছে, তার থেকে প্রতিশোধও গ্রহণ করেননি। তবে মহীয়ান ও গরীয়ান আল্লাহর মর্যাদা হানিকর কোন কিছু করলে তিনি তার প্রতিশোধ নিয়েছেন।"[২৭]
.
তাহলে আয়েশা (রা) এই ধাক্কাকে প্রহার হিসেবে মনে করেন নি কেননা এটা তার কাছে প্রহার মনে হয়নি। বন্ধুরাও অনেক সময় ইয়ার্কি করে একজন আরেকজনকে সামান্য চড় থাপ্পর পর্যন্তও মারে। কিন্তু এটাকে কেউ প্রহার হিসেবে ধরে না, আর এতে কারও গুরুতর ক্ষতিও হয় না। আর এসকল ইসলামবিদ্বেষী এত বড় গণ্ডমূর্খ যে, তারা এটুকুও বুঝতে পারেনি যে, একটা সামান্য ধাক্কা মানেই প্রহার করা না। এটা এতই সামান্য ছিল যে, মা আয়েশা (রা) এরও মনে হয়নি যে তাঁর স্বামী তাকে প্রহার করেছেন আর তাই তিনি উক্ত হাদিসে বর্ণনা করেছেন "রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নিজ হাতে কোন দিন কাউকে মারেন নি, কোন স্ত্রীলোককেও না..."।
.
ইসলামবিদ্বেষীরা আরও একখানা হাদিস পেশ করে প্রমাণ করতে চায় যে, ইসলাম স্ত্রীকে বেধরে মারার অনুমতি দিচ্ছে।
.
"মুহাম্মদ ইবনু বাশশার (রহঃ) ... ইকরামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রিফাআ তার স্ত্রীকে তালাক দেয়। পরে আবদুর রহমান কুরাযী তাকে বিবাহ করে। আয়িশা (রাঃ) বলেনঃ তার গায়ে একটি সবুজ রঙের উড়না ছিল। সে আয়িশা (রাঃ) এর নিকট অভিযোগ করলেন এবং (স্বামীর প্রহারের দরুন) নিজের গায়ের চামড়ার সবুজ বর্ণ দেখালো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এলেন, আর লোকেরা একে অন্যের সহযোগিতা করে থাকে, তখন আয়িশা (রাঃ) বললেনঃ কোন মুমিন মহিলাকে এমনভাবে প্রহার করতে আমি কখনও দেখিনি। মহিলাটির চামড়া তার কাপড়ের চেয়ে অধিক সবুজ হয়ে গেছে। বর্ণনকারী বলেনঃ আবদুর রহমান শুনতে পেল যে, তার স্ত্রী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসেছে। সুতরাং সেও তার অন্য স্ত্রীর দুটি ছেলের সাথে করে এলো। স্ত্রীলোকটি বললঃ আল্লাহর কসম! তার উপর আমার এ ছাড়া আর কোন অভিযোগ নেই সে, তার কাছে যা আছে, তা আমাকে এ জিনিসের চেয়ে বেশী তৃপ্তি দেয় না। এ বলে তার কাপড়ের আচল ধরে দেখান।
.
আবদূর রহমান বললঃ ইয়া রাসুলাল্লাহ! সে মিথ্যা কাছে, আমি তাকে ধোলাই করি চামড়া ধোলাই করার ন্যায়। (অর্থাৎ পূর্ণ শক্তির সাথে দীর্ঘস্থায়ী সঙ্গম করি)। কিন্তু সে অবাধ্য স্ত্রী, রিফাআর কাছে ফিরে যেতে চায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ব্যাপার যদি তাই হল তাহলে রিফাআ তোমার জন্য হারাম হবে না, অথবা তুমি তার যোগ্য হতে পার না, যতক্ষন না আবদুর রহমান তোমার সুধা আস্বাদন করবে। বর্ণনাকারী বলেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুর রহমানের সাথে তার পুত্রদ্বয়কে দেখে বললেনঃ এরা কি তোমার পুত্র? সে বললঃ হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ এই আসল ব্যপার, যে জন্য স্ত্রী লোকটি এরূপ করছে। আল্লাহর কসম কাকের সাথে কাকের যেমন সা’দৃশ থাকে, তার চেয়েও অধিক মিল রয়েছে ওদের সাথে এর (অর্থাৎ আবদুর রহমানের সাথে তার পুত্রদের)।"[২৮]
.
এখানে খেয়াল করুন //সে আয়িশা (রাঃ) এর নিকট অভিযোগ করলেন//, অর্থাৎ মহিলার তার স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। সেই অভিযোগ কী ছিল?
//স্ত্রীলোকটি বললঃ আল্লাহর কসম! তার উপর আমার এ ছাড়া আর কোন অভিযোগ নেই সে, তার কাছে যা আছে, তা আমাকে এ জিনিসের চেয়ে বেশী তৃপ্তি দেয় না। এ বলে তার কাপড়ের আচল ধরে দেখান।//
.
অর্থাৎ মহিলার অভিযোগ সরাসরি স্বামীর প্রহার করা নিয়ে ছিল না, বরং সে তার স্বামীর ভরণপোষণের প্রতি সন্তুষ্ট ছিল না আর এটাই তার অভিযোগ ছিল। এখানে প্রহারের ব্যাপারটি মন্তব্য করেন আয়েশা (রা) যেখানে তিনি বলছেন //কোন মুমিন মহিলাকে এমনভাবে প্রহার করতে আমি কখনও দেখিনি। মহিলাটির চামড়া তার কাপড়ের চেয়ে অধিক সবুজ হয়ে গেছে//; অর্থাৎ এটা আয়েশা (রা) এর মন্তব্য। কিন্তু মহিলাটি স্বামীর প্রহার নিয়ে সরাসরি অভিযোগ করে নি। তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এই ব্যাপারে কিছু বলেন নি। ইসলামবিদ্বেষীরা এথেকে ধরেই নিয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বামীকে অনুমতি দিয়েছেন স্ত্রীকে বেধরে মারার জন্য। কিন্তু তাদের যেন হাদিসের এই অংশটুকু কখনও চোখেই পড়ে না -
.
"....রমণীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহধর্মিণীগণের নিকট পুনঃপুন এসে স্বামীদের (অত্যাচারের) ব্যাপারে অভিযোগ করতে লাগল। সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, শুনে রাখ! আমার পরিবার-পরিজনের নিকট স্ত্রীগণ স্বামীদের অভিযোগ নিয়ে পুনঃপুন আসছে যে, তোমাদের মধ্যে (যারা স্ত্রীদেরকে এরূপে কষ্ট দেয়) তারা কোনক্রমেই ভালো মানুষ নয়।"[২৯]
.
তাহলে স্ত্রীকে বেধরে পিটানোর অনুমতি কোথাও নেই, এটা সুস্পষ্ট মিথ্যাচার!!!
.
ইসলামবিদ্বেষী আরও এক ধরণের হাদিসের উদ্ধৃতি দেয় যেখানে হাফসা (রা)-কে উমার(রা) এবং আয়েশা (রা)-কে আবু বকর(রা) মেরেছিলেন। কিন্তু উমার(রা) ছিলেন হাফসা(রা) এর পিতা, আবার আবু বকর(রা) ছিলেন আয়েশা(রা) এর পিতা। তাহলে পিতা তার কন্যাকে সামান্য শাসন করছে, আর এই দেখেই ইসলামবিদ্বেষীদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে! কতবড় বিকৃত চিন্তার মানসিকতা হলে তারা এথেকে এসব মূর্খ সিদ্ধান্ত নেয় যে, ইসলাম স্বামীকে স্ত্রী নির্যাতনের অনুমতি দিচ্ছে!!!
.
নিজেদের বড় বড় পণ্ডিত মনে করা ইসলামবিদ্বেষীরা সহিহ হাদিস বাদ দিয়ে যইফ বা দুর্বল হাদিস দিয়েও চেঁচামেচি শুরু করে এই বলে যে, স্ত্রী মারলে কোনো সমস্যা নেই।
.
"আশআস ইবনু কায়েস (রহ.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি এক রাতে ‘উমার (রাঃ)-এর বাড়িতে মেহমান হলাম। মধ্যরাতে ‘উমার (রাঃ) তার স্ত্রীকে প্রহার করতে উঠলেন। আমি তাদের দু’জনের মাঝে প্রতিবন্ধক হলাম। অতঃপর ‘উমার (রাঃ) শয্যা গ্রহণ করে আমাকে বলেন, হে আশআস! তুমি আমার থেকে একটি বিষয় মনে রাখবে যা আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট শুনেছি।
.
**স্বামী তার স্ত্রীকে প্রহার করলে এ ব্যাপারে জওয়াবদিহি করতে হবে না,** বিতর সলাত না পড়ে ঘুমাবে না। রাবী বলেন, আমি তৃতীয় কথাটি ভুলে গেছি।"[৩০]
.
উক্ত হাদিসের রাবী আব্দুর রহমান আল মুলসী সম্পর্কে আবুল ফাতহ আল-আযদী বলেন, তার ব্যাপারে সমালোচনা রয়েছে। ইবনু হাজার আল-আসকালানী বলেন, তিনি মাকবুল। ইমাম যাহাবী বলেন, তার পরিচয় সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। ইয়াহইয়া বিন মাঈন তাকে সিকাহ বলেছেন। (তাহযীবুল কামালঃ রাবী নং ৩৪০৩, ১৮/৩০ নং পৃষ্ঠা)
আর প্রখ্যাত মুহাদ্দিস বা হাদিস বিশেষজ্ঞ আলবানিও এই হাদিসটিকে যইফ বা দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর যইফ হাদিসের ওপর আমল করা যাবে না যখন এর বিপরীতে সুস্পষ্ট সহিহ হাদিস আছে।
.
.
আমার লেখাটি শেষ করার করব শেষ একটা পয়েন্ট দিয়ে।
.
"আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ প্রকৃত সচ্চরিত্রবান ব্যক্তিই সর্বোত্তম মু’মিনদের অন্তর্ভুক্ত। আর তোমাদের মধ্যে উত্তম ঐ ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম।"[৩১]
.
তবে এই হাদিসটিতে আবূ দাঊদ ‘সর্বোত্তম ব্যবহার’ পর্যন্ত বর্ণনা করেছেন।
.
এখন উত্তম হোক কিংবা সর্বোত্তম, যাই বলি না কেন, একজন স্বামী ততক্ষণ পর্যন্ত তার স্ত্রীর নিকট ভাল হতে পারে না, যতক্ষণ না সে তার স্ত্রীর মন জয় করতে পারছে। ইসলামবিদ্বেষীদের কাছে আমাদের প্রশ্ন, স্ত্রীর মনজয় করতে হলে কি তাকে মারধর করতে হয় নাকি চারটে কটু কথা শোনাতে হয়? বরং স্ত্রীর মন পেতে হলে স্বামীকে স্ত্রীর সাথে সদ্ভাবে চলতে হবে, তাকে আপন করে নিয়ে ভালবাসতে হবে, তার ইচ্ছাগুলো পূরণের চেষ্টা করতে হবে, এমনকি প্রয়োজনে তার চারটে কড়া কথাও হজম করা লাগতে পারে! তাহলে এর সাথে স্ত্রী মারারই বা সম্পর্ক কী বা তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনেরই বা সম্পর্ক কী??? বরং আসল সমস্যা হল এসকল ইসলামবিদ্বেষীদের যারা নিজেরাই মানসিক সমস্যায় জর্জরিত আর তাদের বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি তারা আজ আরোপ করে চলেছে ইসলামের ওপর।
.
"আয়িশাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের মাঝে সে-ই ভাল যে তার পরিবারের নিকট ভাল। আর আমি আমার পরিবারের নিকট তোমাদের চাইতে উত্তম। আর তোমাদের কোন সঙ্গী মৃত্যুবরণ করলে তার সমালোচনা পরিত্যাগ করো।"[৩২]
.
.
আল্লাহই ভাল জানেন।
.
.
.
________________________
তথ্যসূত্রঃ
[১] আল-কোরআন, ২:২২৩
[২] সুনানে ইবনে মাজাহ/অধ্যায়ঃ ৯/ বিবাহ (كتاب النكاح)/হাদিস নম্বরঃ ১৮৫৫;
মুসলিম ১৪৬৭, নাসায়ী ৩২৩২, আহমাদ ৬৫৩১;
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) http://www.hadithbd.com/share.php?hid=32774
[৩] তাফসিরে আহসানুল বয়ান/আল-কোরআন ২:২২৩ আয়াতের তাফসির হতে বিবৃত
[৪] তাফসির আবু বকর যাকারিয়া/আল-কোরআন ২:২২৩ আয়াতের তাফসির হতে বিবৃত
[৫] সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
অধ্যায়ঃ ৬/ বিবাহ (كتاب النكاح)
হাদিস নম্বরঃ ২১৪১
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) http://www.hadithbd.com/share.php?hid=59509
[৬] আল-কোরআন, ২:২৮৬
[৭] আল-কোরআন, ৪:১৯
[৮] তাফসিরে আহসানুল বয়ান/আল-কোরআন ৪:১৯ আয়াতের তাফসির হতে বিবৃত
[৯] সহীহ বুখারী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৫৪/ বিয়ে-শাদী (كتاب النكاح)
হাদিস নম্বরঃ ৪৭৬০
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) http://www.hadithbd.com/share.php?hid=5066
[১০] সহীহ বুখারী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৫৪/ বিয়ে-শাদী (كتاب النكاح)
হাদিস নম্বরঃ ৪৭৬১
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) http://www.hadithbd.com/share.php?hid=5067
[১১] সহীহ বুখারী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৫৪/ বিয়ে-শাদী (كتاب النكاح)
হাদিস নম্বরঃ ৪৭৪৫
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) http://www.hadithbd.com/share.php?hid=5051
[১২] দাইলামি’র মুসনাদ আল-ফিরদাউস, ২/৫৫
[১৩] মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস নং-১০৪৬৮
[১৪] আল-কোরআন, ৪:৩৪
[১৫] আল-কোরআন, ৪৯:১৩
[১৬] সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
অধ্যায়ঃ ৬৭/ বিয়ে (كتاب النكاح)
হাদিস নম্বরঃ ৫১৮৮
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) http://www.hadithbd.com/share.php?hid=29751
[১৭] আল-কোরআন, ২:১৮৭
[১৮] সূনান তিরমিজী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ১২/ শিশুদের দুগ্ধপান (كتاب الرضاع)
হাদিস নম্বরঃ ১১৬৪
ইবনু মাজাহ ১৮৫১, তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ১১৬৩ [আল মাদানী প্রকাশনী]
হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan) http://www.hadithbd.com/share.php?hid=18356
[১৯] সহীহ বুখারী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৫৪/ বিয়ে-শাদী (كتاب النكاح)
হাদিস নম্বরঃ ৪৮২৫
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) http://www.hadithbd.com/share.php?hid=5131
[২০] বুলুগুল মারাম
অধ্যায়ঃ পর্ব - ৮ঃ বিবাহ (كتاب النكاح)
হাদিস নম্বরঃ ১০১৮;
আবূ দাউদ ২১৪২-২১৪৪; ইবনু মাজাহ ১৮৫০; হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) http://www.hadithbd.com/share.php?hid=70829
[২১] সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
অধ্যায়ঃ ৬/ বিবাহ (كتاب النكاح)
হাদিস নম্বরঃ ২১৪৪
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) http://www.hadithbd.com/share.php?hid=59512
[২২] আল-কোরআন, ৪:১৯
[২৩] মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
অধ্যায়ঃ পর্ব-১৩ঃ বিবাহ (كتاب النكاح)
হাদিস নম্বরঃ ৩২৪০;
মুসলিম ১৪৬৯, আহমাদ ৮৩৬৩, সহীহ আত্ তারগীব ১৯২৮, সহীহ আল জামি‘ ৭৭৪১। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) http://www.hadithbd.com/share.php?hid=68565
[২৪] সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
অধ্যায়ঃ ৪৬/ অত্যাচার, কিসাস ও লুণ্ঠন (كتاب المظالم)
হাদিস নম্বরঃ ২৪৬৮
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) http://www.hadithbd.com/share.php?hid=26530
[২৫] সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
অধ্যায়ঃ ৬৭/ বিয়ে (كتاب النكاح)
হাদিস নম্বরঃ ৫২০৫
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) http://www.hadithbd.com/share.php?hid=29768
[২৬] সহীহ মুসলিম (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ১২/ জানাযা সম্পর্কিত (كتاب الجنائز)
হাদিস নম্বরঃ ২১২৮
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) http://www.hadithbd.com/share.php?hid=11493
[২৭] সহীহ মুসলিম (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৪৫/ ফযীলত (كتاب الفضائل)
হাদিস নম্বরঃ ৫৮৪২
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) http://www.hadithbd.com/share.php?hid=15712
[২৮] সহীহ বুখারী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৬৪/ পোষাক-পরিচ্ছদ (كتاب اللباس)
হাদিস নম্বরঃ ৫৪০৮
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) http://www.hadithbd.com/share.php?hid=6052
[২৯] মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
অধ্যায়ঃ পর্ব-১৩ঃ বিবাহ (كتاب النكاح)
হাদিস নম্বরঃ ৩২৬১;
আবূ দাঊদ ২১৪৬, ইবনু মাজাহ ১৯৮৫, দারিমী ২২৬৫, সহীহ ইবনু হিব্বান ৪১৮৯, সহীহ আল জামি‘ ৭৩৬০। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) http://www.hadithbd.com/share.php?hid=68588
[৩০] সুনানে ইবনে মাজাহ
অধ্যায়ঃ ৯/ বিবাহ (كتاب النكاح)
হাদিস নম্বরঃ ১৯৮৬
আবূ দাউদ ২১৪৭, ইরওয়াহ ২০-৩৪, যঈফাহ ৩৭৭৬, যইফ আল-জামি' ৬২১৮। তাহকীক আলবানীঃ যঈফ।
হাদিসের মানঃ যঈফ (Dai'f) http://www.hadithbd.com/share.php?hid=32948
[৩১] মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
অধ্যায়ঃ পর্ব-১৩ঃ বিবাহ (كتاب النكاح)
হাদিস নম্বরঃ ৩২৬৪;
তিরমিযী ১১৬২, আবূ দাঊদ ৪৬৮ ২, আহমাদ ৭৪০২, সহীহাহ্ ২৮৪, সহীহ আল জামি‘ ১২৩২, সহীহ আত্ তারগীব ১৯২৩। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan) http://www.hadithbd.com/share.php?hid=68591
[৩২] সূনান আত তিরমিজী [তাহকীককৃত]
অধ্যায়ঃ ৪৬/ রাসূলুল্লাহ ﷺ ও তার সাহাবীগণের মর্যাদা (كتاب المناقب عن رسول الله ﷺ)
হাদিস নম্বরঃ ৩৮৯৫
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) http://www.hadithbd.com/share.php?hid=42219

Post a Comment

0 Comments